২০০৪ সালের ক্রিসমাসের ঠিক পরে, মাইক ব্রাউনের নেতৃত্বে পালোমার অবজারভেটরির একটি দল, আগে তোলা ছবি পর্যবেক্ষন করতে ছিলো সেই ছবিগুলিতে একটি ছোট, প্লুটো-আকারের দেহ আবিষ্কার করেছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তখন শিলাটির ডাকনাম দেন “সান্তা”।
ব্রাউনের দল তাদের তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করে, প্রায় একই সময় জোসে লুইস অরটিজ মোরেনোর নেতৃত্বে সিয়েরা নেভাদা অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি দল ২০০৩ সালের মার্চ মাসে তোলা ছবিতে তাদের আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়। মূলত 2003 EL61 হিসাবে মনোনীত, মহাজাগতিক বস্তুটি এখন হাউমিয়া নামে পরিচিত। এটি সৌরজগতের সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে বস্তুগুলির মধ্যে একটি।
হাউমিয়ার নামকরণ করা হয়েছে শিশুর জন্ম ও উর্বরতার হাওয়াইয়ান দেবীর নামানুসারে। এর দুটি চাঁদের নামকরণ করা হয়েছিল দেবীর কন্যা হিয়াকা এবং নামাকার নামে, যারা হাউমিয়ার দেহ থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলো।
হাউমিয়া হল কুইপার বেল্টের পরিচিত বামন গ্রহগুলোর মাঝে তৃতীয় বৃহত্তম। কুইপার বেল্টের অন্যান্য পরিচিত বামন গ্রহগুলি হল প্লুটো, এরিস এবং মেকমেক। কুইপার বেল্টে এর পাশাপাশি হাজার হাজার ছোট বস্তু রয়েছে।
হাউমিয়ার বৈশিষ্ট্য
হাউমিয়া সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে ২৮৫ পৃথিবী-বছর সময় নেয়।এটি পৃথিবী-সূর্য দূরত্বের মাত্র 34 গুণের মধ্যে আসে, যখন এটি সবচেয়ে দূরে, তখন এটি ৫১ গুণেরও বেশি দূরে থাকে।এই দূরত্বের কারনে বিজ্ঞানীদের পক্ষে এটির ভর এবং ঘনত্ব সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন করে তুলে।
এটি আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে দ্রুত ঘূর্ণায়মান বড় বস্তুগুলির মধ্যে একটি। এটি প্রতি ৪ ঘন্টায় তার অক্ষের উপর একটি পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। হাউমিয়ার এই দ্রুত ঘূর্ণন এটিকে গোলক আকৃতি পেতে বাধা দেয়, পরিবর্তে এটিকে কিছুটা চ্যাপ্টা রাগবি বলের মতো দেখায়।
যদিও এর আকৃতিটি সরাসরি দেখা যায়নি, তবে এর আলোক বক্ররেখা থেকে গণনা করা হচ্ছে এটি একটি জ্যাকোবি উপবৃত্তাকার।এর প্রধান অক্ষটি তার ছোটটি থেকে দ্বিগুণ লম্বা। হাউমিয়ার ব্যাসার্ধ প্রায় ৩৮৫ মাইল (৬২০ কিলোমিটার)।পৃথিবীর ব্যাসার্ধের প্রায় ১/১৪ পৃথিবী যদি একটি নিকেলের আকার হত তবে হাউমিয়া একটি তিল বীজের মতো বড় হবে।হাউমিয়ার ভর প্লুটোর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং পৃথিবীর ১/১৪০০।
হাউমিয়ার সূর্য থেকে গড় দূরত্ব ৪,০১০,০০০,০০০মাইল (৬,৪৫২,০০০,০০০ কিলোমিটার)। হাউমিয়া সূর্য থেকে ৪৩ এস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরে। এই দূরত্ব এতটাই যে হাউমিয়ায় সূর্যের আলো আসতে ৬ ঘন্টা সময় লাগে। কক্ষপথে হাউমিয়ার গড় গতি ৪.৫৩১কিমি/সেকেন্ড।
হাউমিয়ার উপরিভাগে একটি গাঢ় লাল দাগ আছে বলে মনে হয় যাতে ধারনা করা হয় এর চারপাশের বরফের চেয়ে বেশি খনিজ এবং জৈব যৌগ থাকতে পারে।
হাউমিয়া কেন এতো দ্রুত ঘুরছে?
দ্রুত ঘূর্ণন, রিং এবং উচ্চ অ্যালবেডো (বরফের পৃষ্ঠ) সহ হাউমিয়ার দীর্ঘায়িত আকৃতিটি মূলত একটি বিশাল সংঘর্ষের পরিণতি বলে মনে করা হয়। বিজ্ঞানীরা একটি হাইপোথিসিস তৈরি করেছেন যার সাহায্যে হাউমিয়ার এই দ্রুত ঘূর্ণের ব্যাখ্যা করা হয়।
৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে, যখন সৌরজগৎ গঠনের প্রক্রিয়াধীন ছিল, তখন যে বস্তুটি এখন হাউমিয়া তা ছিলো অর্ধেক বরফ এবং অর্ধেক শিলা। তখন এটি ছিলো প্রায় প্লুটোর আকারের একটি বলের মতো।আরেকটি বৃহৎ কুইপার বেল্ট বস্তু হাউমিয়ার সাথে তির্যকভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।
এই সংঘর্ষের ফলে হাউমিয়ার ভূপৃষ্ঠের বেশিরভাগ বরফ ছিটকে গেছে। বরফের পাতলা একটি অংশ শুধু একটি শিলা আবৃত করে রেখে গেছে। তির্যক প্রভাবের কারণে হাউমিয়া দ্রুত ঘোরে। আর এই দ্রুত ঘূর্ণন হাউমিয়াকে রাগবি ফুটবলের আকারে পরিনত করেছে যা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি।
হাউমিয়ার দুটি পরিচিত চাঁদ আছে। নামাকা হল অভ্যন্তরীণ চাঁদ, এবং হিয়াকা হল বাইরের চাঁদ। দুই উপগ্রহই বেশ ছোট বলে মনে হচ্ছে।বড় চাঁদটি সম্ভবত প্রাথমিক ভরের ১% এবং ছোট চাঁদটি প্রাথমিক ভরের মাত্র ০.২%।
প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে হাউমিয়ার চারপাশে ভ্রমণ করতে হিয়াকা ৪৯ দিন সময় নেয়।অভ্যন্তরীণ উপগ্রহ, নামকা, একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে হাউমিয়ার চারপাশে ভ্রমণ করতে ১৮ দিন সময় নেয়।উভয় চাঁদই প্রায় বিশুদ্ধ
পানি-বরফ দ্বারা গঠিত বলে মনে করা হয়, যা মূলত হাউমিয়া থেকেই এসেছে।হাউমিয়ার চাঁদগুলি একসময় এর পৃষ্ঠের অংশ ছিলো, অনেকটা পৃথিবীর চাঁদের মতন একটি সংঘর্ষের পরে তৈরি হয়েছিল।
হাউমিয়ার প্রথম চাঁদ ২৮শে জানুয়ারী ২০০৫-এ কেক অবজারভেটরিতে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছিল।
কুইপার বেল্টের প্রায় ১০% বস্তুর উপগ্রহ রয়েছে, তবে কুইপার বেল্টের অন্য কোনো বস্তুর একাধিক উপগ্রহ আছে বলে জানা যায়নি। হাউমিয়া হল প্রথম পরিচিত কুইপার বেল্ট অবজেক্ট যার রিং রয়েছে। বামন গ্রহটি ২০১৭ সালে ২১ শে জানুয়ারী URAT1 533-182543 নামের নক্ষত্রের সামনে দিয়ে ভ্রমন করার সময় বিজ্ঞানীরা এই রিং আবিষ্কার করেন।রিংটির ব্যাসার্ধ প্রায় 2,287 কিমি, প্রস্থ ~70 কিমি এবং অস্বচ্ছতা 0.5।
নক্ষত্রের আলো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদেরকে হাউমিয়ার দীর্ঘতম অক্ষকে আরও সঠিকভাবে পরিমাপ করতে সাহায্য করেছিল যা আগের অনুমানের চেয়ে 17 শতাংশ বড়। বামন গ্রহ হাউমিয়া একটি গোষ্ঠীর সদস্য যারা নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে একটি চাকতির মতো অঞ্চলে প্রদক্ষিণ করে যাকে কুইপার বেল্ট বলা হয়।
.
এই দূরবর্তী অঞ্চলটি হাজার হাজার ক্ষুদ্র বরফের বস্তর আবাস যা প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের সৌরজগতের ইতিহাসের প্রথম দিকে গঠিত হয়েছিল।এই বরফ, পাথুরে বস্তুগুলোকে কুইপার বেল্ট বস্তু, বা ট্রান্সনেপচুনিয়ান (transneptunian) বস্তু বা প্লুটোয়েড (plutoids) বলা হয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হাউমিয়ার পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত সূর্যালোকের আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছেন যে হাউমিয়া বরফের আবরণযুক্ত শিলা দিয়ে তৈরি। হাউমিয়ার পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় -২৪০°সে (৩২কে) মনে করা হয়। হাউমিয়ার বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু জানা যায়নি।
প্লুটো এবং মেকমেকের পরে কুইপার বেল্টের তৃতীয় উজ্জ্বল বস্তু হল হাউমিয়া। এর আপাত ঔজ্বল্যের মাত্রা ১৭.৩ একটি ভাল মানের টেলিস্কোপ দিয়ে রাতের আকাশে হাউমিয়া দেখা সম্ভব।
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply