বিবর্তন বিষয়ে একটা প্রচলিত ভুল দৃষ্টিভঙ্গি হলো,বিবর্তন যেহেতু প্রতিযোগিতার কথা বলে তাহলে বিবর্তনের ধারায় প্রাণীদের স্বার্থপর হয়ে উঠবার কথা, অন্য প্রাণীকে সদা শত্রুজ্ঞান করার কথা, তাদের প্রতি সদা সহিংস হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু জীবজগতে প্রাণীদের আচার-আচরণ দেখে মনে হয় পারস্পরিক সংযোগ ও নির্ভরশীলতাই যেন তাদের জীবনক্রিয়া পরিচালনার চাবিকাঠি। বিবর্তন কী তবে জীবজগতে কিংবা মানবজগতে সহযোগিতা,সহৃদয়তা,সহানুভূতি ইত্যাদি সদগুণের যেসব উদাহরণ আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই,এবং দেখে হৃদয়াবেগে আপ্লুত হয়ে উঠি,তার উদ্ভব ব্যাখ্যা করতে অক্ষম? ব্যাপারটাকে একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।
আদতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণীদের সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ বিকাশের যথেষ্ঠ শক্তিশালী ব্যাখ্যা আমাদের হাতে আছে। তার একটি হলো ‘কিন সিলেকশন’।‘কিন’ শব্দের অর্থ হলো আত্মীয়,বা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী। ‘জ্ঞাতি’ মানে একই বংশে জন্মানো ব্যক্তি। আমরা বলি অমুক বংশের রক্ত বইছে তোমার শরীরে। ‘কিন সিলেকশন’ বুঝতে এই প্রচলিত কথাটাই যথেষ্ঠ। একই জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মানুষের একজন সাধারণ পূর্বপুরুষ থাকেন। আপনি এবং আপনার চাচাতো ভাইদের জন্য সেই পূর্বপুরুষ আপনার দাদু। আপনি এবং আপনার মামাতো ভাইদের জন্য সেই পূর্বপুরুষ আপনার নানা।
আপনাদের মধ্যে যে ‘আত্মীয়তা’,জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কার্যত তা জিনগত সাদৃশ্য কেননা ওই পূর্বপুরুষের জিনের প্রতিরূপ জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সকলেই বহন করে। তাই গোষ্ঠীর কোন সদস্যকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করলে, প্রজাতিতে ওই সাধারণ (Common) জিনের বংশবিস্তার সুরক্ষিত হবে। বিবর্তন বলছে, যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য এক প্রাণী আপনার সমরূপ জিন বহন করে, তখন তাকে সাহায্য করা, তার সাথে খাদ্য ভাগ করে নেওয়া, বিপদে পড়লে তাকে রক্ষা করা ব্যক্তি হিশেবে আপনার বিবর্তনীয় উপযোগিতা বাড়াবে। আর সেজন্যই, জীব নির্বিশেষে সন্তানের প্রতি, পরিবারের প্রতি, নিকটাত্মীয়ের প্রতি বা গোত্রের প্রতি একধরনের জৈবিক টান উপলব্ধি করে, এবং তাদেরকে রক্ষার চেষ্টা করে। যেকোনো দলে, যেখানে দলের সদস্যরা বাকিদের সাথে নিকট সম্পর্কিত, সেখানে কোনো একক সদস্যের সহযোগিতাপূর্ণ হওয়া তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেও দরকারি বটে।
আরেকটি ব্যাখ্যা হলো ‘রেসিপ্রোকাল অলট্রুইজম’। ‘রেসিপ্রোকাল’ মানে পারস্পরিক,’অলট্রুইজম’ এর অর্থ করা যেতে পারে পরার্থপরতা বা উপকার করার প্রবণতা। যখন একই প্রজাতির অনেকগুলো প্রাণী একসাথে সহাবস্থান করে, তখন তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া ঘটতে থাকে। সহজ কথায়, আন্তঃসম্পর্কিত জীবগুলো একটি অন্যটিকে সহায়তা করে। এই সহযোগিতার চুক্তি যতদিন বিদ্যমান থাকে,বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ওই জীবগুলোর যাবতীয় প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে টিকে থাকার সম্ভাবনাও ততোদিন অটুট থাকে।
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হতে পারে কিন সিলেকশন বা অলট্রুইজম আপাতদৃষ্টিতে বিবর্তনের জীবন সংগ্রাম (struggle for existence) তত্ত্বের সঙ্গে খাপ খায় না। বিবর্তনের ভাষায় ফিটনেস বা অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকা বলতে বোঝায় ‘রিপ্রোডাকটিভ ফিটনেস’। প্রত্যেক প্রাণীই চায় তার রিপ্রোডাকটিভ ফিটনেস বাড়াতে, অর্থাৎ, সন্তান উৎপাদন করে টিকে থাকতে। সন্তানের মধ্যে প্রাণীর জিন প্রবাহিত হবে এবং তা একের পর এক জননচক্রের মাধ্যমে ভবিষ্যতে স্থায়িত্ব পাওয়ার পথে হাঁটবে। এ ক্ষেত্রে সমস্ত জিনই ‘সেলফিশ’। স্মরণ করতে চাই পণ্ডিত রিচার্ড ডকিন্সের কাব্যময় পঙ্ক্তি
আমরা সবাই একেকটি টিকে থাকার যন্ত্র (survival machine)- অন্ধভাবে প্রোগ্রাম করা একটি নিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক বাহন মাত্র – যার উদ্দেশ্য কেবল স্বার্থপরভাবে এক ধরণের জৈবঅণুকে সংরক্ষণ করা। … তারা আমার ভেতরে আছে, তারা রয়েছে আপনার ভেতরেও; তারাই আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমাদের দেহ আর আমাদের মন; আর তাদের সংরক্ষণশীলতাই আমাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত মৌলিকত্ব। ওই অনুলিপিকারকেরা এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। এখন তাদেরকে জিন বলে ডাকা হয়, আর আমরা হলাম তাদের উত্তরজীবীতার যন্ত্র…
স্বার্থপরের মতোই প্রতিটি জিন চায় নিজেকেই শুধু টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু এই তত্ত্বে ‘আপাত’ বাদ সাধে অলট্রুইজম। নিজেকে বলিদান দিলে সেই প্রাণীটির জিনের তো আর টিকে থাকা হল না। তা হলে? বস্তুত,জিনের এই স্বার্থপরতা থেকেই পরার্থপরতার মতো এক ধরণের বিপরীতমুখী অভিব্যক্তির উদ্ভব ঘটতে পারে । উপরের দুটো ব্যাখ্যাতেও জিনের টিকে থাকাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে—তবে তা একটি প্রজাতির একটি সদস্যের জিন নয়: গুরুত্ব পায় সমগ্র গোষ্ঠীর জিন সমষ্টি এবং প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে গোটা প্রজাতির শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াই। স্বার্থপর জিন বৃহত্তর স্বার্থে যেমন আত্মত্যাগ কিংবা পরার্থপরতা তৈরি করে, ঠিক তেমনি প্রতিযগিতামূলক জীবন সংগ্রামের অংশ হিশেবেই জীবজগতে ঘটে থাকে পারষ্পরিক সহযোগিতা, আন্তঃক্রিয়া কিংবা সহ-বিবর্তনের বিচিত্রমুখী প্রপঞ্চ।
সুতরাং নিজে টিকে থাকার ভীষণ স্বার্থপর জৈবিক তাড়না সত্ত্বেও পরিবার কিংবা বৃহত্তর সমাজের মধ্যে কীভাবে আমরা সহযোগিতা-হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে তুলি—বিবর্তন তত্ত্বের কাছে এটা মোটেই কোনো ধোঁয়াশা নয়। আমরা দেখলাম নির্দয় জৈবিক প্রতিযোগিতার মাঝেই পরার্থপরতার বীজ লুকিয়ে থাকে, আর তারপর এক সময় মহীরূহ আকারে জীবজগতে উদ্ভুত হয় সহযোগিতা, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের মত অভিব্যক্তিগুলো। জীবজগত থেকে এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত হাজির করা সম্ভব। রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার বাদুরেরা নিজেদের মধ্যে খাদ্য ভাগাভাগি করে: বানর এবং গরিলারা তাদের দলের কোন সদস্য মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত থাকলে তাকে সহায়তা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে: এমনকি ‘দশে মিলে’ কাজ করে তার জন্য খাবার পর্যন্ত নিয়ে আসে। ডলফিনেরা অসুস্থ অপর সহযাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে সৈকতের দিকে নিয়ে যায়,যার ফলে অসুস্থ ডলফিনটির পর্যাপ্ত আলো বাতাস পেতে সুবিধা হয়, তিমি মাছেরা তাদের দলের অপর কোন আহত তিমি মাছকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করে,হাতিরা তাদের পরিবারের অসুস্থ বা আহত সদস্যকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে।
মানুষ হিশেবে আমাদের সহৃদয়তার পরিসর সম্ভবত এরচে’ও বড়ো। শহরের চৌরাস্তায় কোনো আগন্তুক যখন অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন,এদিক-ওদিক তাকাতে থাকেন ফ্যালফ্যাল করে—কিছু মানুষ এগিয়ে যায় তার দিকে, জিগ্যেশ করে,’আপনি কি পথ হারিয়েছেন? আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ অর্থাৎ যাদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা নেই, যাদের কখনো দেখিনি আগে—এমন অপরিচিত আগন্তককেও আমরা সাহায্য করি; আমরা চিন্তা করি শুধু আমাদের গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য নয়,সহস্র মাইল দূরের অচেনা-অজানা মানুষটির জন্যেও। যে মানুষ অভাবী,যার হয়তো প্রয়োজন খাদ্য,পানীয়,আবাস বা বস্ত্রের—জাতি-বর্ণ-গোত্র পরিচয় বিবেচনা না করেই বহু মানুষ তার জন্য ব্যয় করে নিজের শ্রমলব্ধ অর্থ।
এরপর উঠতে পারে সেসব ঘটনার কথা যেখানে আমরা দেখি মানুষ অন্য মানুষের জন্য , ক্ষেত্রবিশেষে সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা মানুষের জন্য, নিজের জীবন বিপন্ন করছে কিংবা নিজেকেই বলিদান করছে। কেউ কেউ হয়তো বলবেন,”এটা তো ডারউইনীয় বিবর্তনের ফল হতে পারে না! আমাদের তো নিজেদের বা নিদেনপক্ষে নিজের গোষ্ঠীর জিনের বংশানুক্রমিক সঞ্চারণ নিয়ে চিন্তিত থাকবার কথা,কেন বাপু আমি আমার জিনের সুস্থসবল ধারক দেহটিকে ধ্বংস করে এমন একটি দেহকে বাঁচাবো যা কী না আমার জিন মোটেই ধারণ করে না?” এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের একক,আকস্মিক আচরণগুলো সরাসরি বিবর্তনের ফলাফল নয়; বিবর্তনের ফল হলো আমাদের মস্তিষ্ক,যা নির্দিষ্ট রকম চিন্তা করে—যার নানারকম জৈবিক প্রবণতা আছে। মগজের কল্যাণে এমনসব জিনিশ নিয়ে ভাবার সক্ষমতা আমাদের মধ্যে বিকশিত হয়েছে, নিছক অন্ধ-নিরাসক্ত জৈববিবর্তনের মাধ্যমে যেগুলোর কথা ভাবা যেতো না। বৃক্ষ-অরণ্য-সমুদ্র-পর্বত-ধূলিমাটির পৃথিবীতে বাস করে আমরা অনুসন্ধান চালাচ্ছি পরমাণুর গহীনে ক্ষুদ্র কণার খোঁজে কিংবা আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিতে। একইভাবে বুদ্ধিমান মানুষের সামাজিক চুক্তির অংশ হিশেবেই বিকশিত হয়েছে নৈতিকতার ধারণা। সেখান থেকে আমরা এই মহাগজাগতিক উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পেরেছি যে কারো জীবনই কম বা বেশি মূল্যবান নয়। জৈবিক তাড়না আমাদের এই-ই ভাবাতে চায় যে আমার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে তা তীব্রতর,যাদের কথা আমি শুনি নি কখনো—সেসব মানুষের প্রতি একই অন্যায় করা হলেও তা লঘুতর। মানুষ এই ক্ষুদ্র জৈবিকতাকে উপেক্ষা করে যে ‘গোল্ডেন রুল’ গ্রহণ করেছে,সেখানে ও দুটোর মধ্যে কোনো তফাত নেই।
এই ব্যাপারটা আমাদের এটাই বুঝিয়ে দেয় যে স্বার্থপরতা,হীনতা,সাম্প্রদায়িকতা,বর্ণবাদ,লিঙ্গবৈষম্য মানবসমাজের এসব অপপ্রবণতাগুলো অনতিক্রম্য নয়; একে পেরিয়ে যাওয়া আমাদের জৈবিক সক্ষমতার বাইরে নয়,সে ক্ষমতা মানুষের মধ্যেই সুপ্ত আছে। মগজের সচেতন ব্যবহার করে তাকে জাগরূক রাখতে না পারলে প্রজাতি হিশেবে আমাদের ভবিষ্যত যে শঙ্কামুক্ত নয়,সে-কথা আজ বলাই বাহুল্য।
স্বীকারোক্তি: এই লেখাটা ইয়েল ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি অ্যান্ড কগনিটিভ সায়েন্স’ বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক Paul Bloom এর ‘Are We a Selfish Species’ শীর্ষক শর্ট লেকচারের রূপান্তর। রূপান্তরের ক্ষেত্রে মূল বক্তব্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেষ্টা করা হয়েছে এবং বক্তব্যের সহজবোধ্যতা ও অলংকরণের স্বার্থে কিছু প্রাসঙ্গিক উদাহরণ ও একটি উক্তি সংযোজিত হয়েছে। এরপরেও কিছু অসম্পূর্ণতা রয়েছে। পপুলেশন জেনেটিক্স পূর্ণাঙ্গ গাণিতিক হিশাব কষে কষে দেখিয়ে দিতে পারে কেনো স্বার্থহীনতা স্বার্থপরতার চেয়ে বেশি বিবর্তনগত সুবিধা দিতে পারে। আগ্রহী পাঠকের জন্য এ সংক্রান্ত ‘হ্যামিলটনের সূত্র’ দ্রষ্টব্য। ৮ ও ৩ নম্বর সূত্রে সংযুক্ত লেখাটিতে এ ব্যাপারে আলাপ করা হয়েছে।
কৃতজ্ঞতা:
১। Paul Bloom এর শর্ট লেকচার
২। জীবন মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, অভিজিৎ রায়, মুক্তমনা
৩। বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব, অভিজিৎ রায়,মুক্তমনা
৪। দ্য সেলফিশ জিন–ব্লগানুবাদ: অনীক আন্দালিব,মুক্তমনা
৫। Why We Hate ডকুমেন্টারি
৬। Why We Are Here ডকুমেন্টারি
৭। Altruistic behavior(Encyclopedia Britannica)
৮। বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করেন আপনার প্রেমিকাকে ধর্ষণ করায় কেনো ধর্ষকের শাস্তি দরকার,প্রজেশ দত্ত,ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান BCB
Leave a Reply