বাংলা ভাষায় স্টেম কোষ নিয়ে কোনো বই না থাকায় এদেশের শিক্ষার্থীসহ বিজ্ঞানপ্রিয় মানুষেরা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে জ্ঞান লাভ থেকে অনেকটাই দূরে ছিল। এই ব্যাপারটিকে উপলব্ধি করতে পেরে তরুণ লেখক অপূর্ব পাল লিখলেন “স্টেম কোষের আদ্যপান্ত”। জীববিজ্ঞানের ভক্ত হওয়ায় বইটি প্রকাশের পরপরই আমি সংগ্রহ করলাম। কী এমন আছে এই বইতে?
বইয়ের ব্যবচ্ছেদ
প্রথম অধ্যায় “জন্মকথা” এর প্রথম কথাগুলো পরেই বুঝলাম যে লেখকের হাত একদম অন্যরকম। অপূর্ব দা স্টেম কোষকে “দেশের প্রধানমন্ত্রী” উপমা দিয়ে গল্পের মাধ্যমে বিষয়টিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। পরবর্তী অধ্যায়ে স্টেম কোষের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে লেখক একদমই সংক্ষেপে কবে, কীভাবে স্টেম সেল নিয়ে বিজ্ঞানীরা কোন মৌলিক গবেষণা করেছেন সেটা তুলে ধরেছেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে স্টেম কোষের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। সাধারণত মাইটোসিসের মাধ্যমে এধরণের কোষগুলো অসংখ্য বার বিভাজিত হতে পারে। যদিও সাধারণ কোষ অল্প কয়েক ধাপ অতিক্রম করার পরে আর বিভাজিত হতে পারে না, কিন্তু স্টেম কোষ বহুবার বিভাজিত হয়।
স্টেম কোষ থেকে বিশেষায়িত কোষের জন্ম হওয়াকে বলে কোষীয় রূপান্তর। স্টেম সেল যখন বিভিন্ন বার্তার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বিশেষায়িত কোষ তৈরিতে উদ্যত হয়, তখন সেই বিশেষায়িত কোষের নির্দিষ্ট জিনে Transcription Factor যুক্ত হয়ে স্টেম কোষে সেই জিনের প্রকাশ ঘটায় এবং সেই বিশেষায়িত কোষটির প্রোটিন উৎপাদিত হয়। ফলে স্টেম কোষ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বিশেষায়িত কোষে পরিণত হয়। এই পুরো বিষয়টিকে নিয়ে অপূর্ব দা সহজ ভাষায় বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন।
পঞ্চম অধ্যায়ে স্টেম কোষের পোটেন্সি নিয়ে কথা বলা হয়েছে। পোটেন্সির উপর ভিত্তি করে স্টেম সেল চার প্রকারঃ টটিপোটেন্ট, প্লুরিপোটেন্ট, মাল্টিপোটেন্ট এবং ইউনিপোস্টেন্ট স্টেম কোষ। ষষ্ট অধ্যায়ে সমজাতীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে স্টেম কোষের প্রকারভেদ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করা হয়েছে। এ আলোচনার সাপেক্ষে স্টেম কোষ ৩ ধরণেঃ ভ্রুণীয় স্টেম কোষ, পরিপক্ব স্টেম কোষ এবং প্রবর্তিত স্টেম কোষ। আর এই তিনটির বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৭ম, ৮ম ও ৯ম অধ্যায়ে।
দশম অধ্যায়ে ক্যান্সার স্টেম কোষের কথা খুঁজে পেয়েছি। ক্যান্সার স্টেম কোষগুলো টিউমারের মধ্যে অবস্থান করে, যার সক্রিয়তার ফলে টিউমার বিকশিত হয় এবং ক্যান্সার কোষ বৃ্দ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তী অধ্যায়ে স্টেম কোষকে ঘিরে কিছু সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের মতে, ডায়াবেটিস, ব্ল্যাড ক্যান্সার, পার্কিনসন্স ডিজিজ, হৃদরোগ ইত্যাদির চিকিৎসা ও প্রতিকারে স্টেম সেল বিশেষ ভূমিকা রাখবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হবে একটি আশীর্বাদ।
স্টেম কোষ নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে, এর ব্যবহার নিয়ে আছে নৈতিকতার প্রশ্ন। একদিকে বিজ্ঞানীদের যুক্তি, অন্যদিকে ধর্মীয় নেতা ও মানবাধিকার সংস্থার কর্মীদের মতামত এই বিতর্ককে দীর্ঘ করেই যাচ্ছে। আর এর প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে স্টেম সেল বিষয়ক গবেষণার সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়টা নিয়েই দ্বাদশ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সর্বশেষ অধ্যায়ে বাংলাদেশে স্টেম সেল বিষয়ক গবেষণা ও স্টেম সেল থেরাপির প্রসার নিয়ে কথা বলা হয়েছে। যদিও আমরা অন্যান্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে, তবুও এই খাতে এখন বিশেষজ্ঞরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। আমাদের বাংলাদেশ কেশেহত্রে কোন অবস্থানে আছে তা এই অধ্যায়টা পড়ে জানতে পেরেছি।
তো, বইটাতে মোটামুটি এগুলো নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।
ভালো লাগা ও মতামত
“দারুণ!”-এই শব্দটা দিয়েই বইটার রিভিউ দিতে চাই। কখনো প্রধানমন্ত্রী, কখনো বা কোকিল-কাক, আবার কখনো কারখানা, কখনো বা ক্যারিয়ারকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করে লেখক খুব সহজেই স্টেম কোষকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন। আমি বইটাকে ভিন্ন আঙিকে খুঁজে পেয়েছি। যেখানে বইয়ের ভূমিকায় সৌমিত্র চক্রবর্তী স্যার নিজেই বইটার প্রশংসা করেছেন, সেখানে আমি আর কী বলব?
আমি সব সময় বইয়ের পর্যালোচনা বা বুক রিভিউ ভিত্তিক আলোচনায় বইয়ের উল্লেখযোগ্য ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করি। কিন্তু এই বইয়ে এমন কোনো ত্রুটি খুঁজে পাইনি, যা নিয়ে কিছু বলা যায়। কিন্তু বইয়ের কোথাও স্টেম সেলের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা দেখিনি। আশা করি পরবর্তীতে পরিবর্তন খুঁজে পাবো। সবশেষে লেখকের প্রতি স্যালুট!
তো, দেরি কীসের? বইটি সংগ্রহ করে পড়া শুরু করুন। একজন পাঠক হিসেবে আমার মতো আপনিও বইটি পড়ে উপকৃ্ত হবেন! Happy Reading!
Leave a Reply