“বিল্ডিংটা অনেক উঁচু,”“লাঠিটা অনেক ছোট,”“ছেলেটা বেশ লম্বা”,“গাছটা বেশ খাটো”- এসব কথা আমরা হরহামেশাই বলি। কিন্তু উঁচু, ছোট বা খাটো এই শব্দগুলো কি আসলেই কোন নির্দিষ্ট পরিমাপকে তুলে ধরে? আসলে এগুলোর কোনো নির্দিষ্ট পরিমাপভিত্তিক সীমা নেই। একটা দোতালা দালানকেও উঁচু বলা হচ্ছে, আবার বুর্জ খলিফাকেও উঁচু বলছি। জিরাফকেও লম্বা বলছি, আবার দেড় মিটারের পিচ্চিকেও লম্বা বলছি। সবকিছুতে কেমন জানি বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে, তাই না? চলুন, এই বিশৃঙ্খলার মাঝে ডুব দেওয়া যাক!
কতটা ভারী?
হাতি বর্তমান জীবজগতের সবচেয়ে ভারি চতুষ্পদ প্রাণী, যার ভর প্রায় ৫×১০৩ কেজি। কিন্তু এই “ভারী” শব্দটা যদি মহাবিশ্বের আলোচনায় ঢুকিয়ে দেওয়া হই, তাহলে কেমন হবে? লক্ষ্য করুন, আমাদের গালাক্সি সূর্যের তুলনায় ১০১১ গুণ ভারী। এক্ষেত্রে গালাক্সি আসলে কতটা ভারী? আমাদের মিল্কিওয়ে গালক্সির ভর হলো ২×১০৪১ কেজি। অর্থাৎ আমাদের গালাক্সির চেয়ে প্রায় ১০৩৮ গুণ ভারী। কিন্তু হাতির ভরকে বিশেষায়িত করতেও আমরা ভারী বলছি, আবার গালাক্সির বিশাল ভরকে বোঝাতেও আমরা ভারী বলছি। (বেচারা গালাক্সির যদি বাকশক্তি থাকতো, তাহলে নিশ্চিত এই অপমানের জবাব দিতো!)
উঁচু-নিচু, ক্ষুদ্র-বৃহৎ
“এভারেস্ট বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালা”, “সিঁড়িগুলো বেশ উঁচু” । দুইটা বাক্যেই উঁচু শব্দটা দ্বারা দুটো ভিন্ন বস্তুকে বিশেষায়িত করা হয়েছে। প্রথমটায় উঁচু মানে ৮,৮৪৯ মিটার। দ্বিতীয়টায় উঁচু মানে ০.১২-০.১৪ মিটার। দেখুন তো দুইটা বাক্যের উঁচুর মধ্যে কত ব্যবধান!
আবার মনে করুন, “২ সেন্টিমিটার” একটা নির্দিষ্ট পরিমাপ। এই পরিমাপের দুটো জিনিসের কথা আপনাকে বলা হলো। একটি হলো ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যটি কাঠি। পাঠক বন্ধুরা হয়ত বা ২ সেন্টিমিটার ব্যাকটেরিয়ার কথা শুনে অবাক হতে পারেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এমন বিশেষ প্রকৃতির ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন, যার দৈর্ঘ্য ২ সেন্টিমিটার। মানে খালি চোখেই ঐ ব্যাকটেরিয়া দেখা যাবে।
যাহোক, এখন এই দুটো বস্তুর মধ্যে আপনার কাছে ব্যাকটেরিয়াকে মনে হবে বিশাল এবং কাঠিটিকে মনে হবে তুচ্ছ কোনো বস্তু। পরিমাপ কিন্তু একই, এরপরেও অনুভব বা উপলব্ধিতে ভিন্নতা কেন? এর কারণ হলো ব্যাকটেরিয়া তার স্বাভাবিক পরিমাপের সীমা ছাপিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কাঠিটা ছোট তো ছোটই রয়ে গিয়েছে। একারণেই একটাকে বিশাল এবং অন্যটা যৎসামান্য কিছু মনে হচ্ছে।
সময়ের দ্বন্দ্ব
“১ সেকেন্ড” সময়টা কি খুব কম নাকি অনেক বেশি? আমরা ইতিমধ্যে চালাক হয়ে গেছি, একারণে এখন দুটোর কোনটিকেই বেছে নিচ্ছি না। কিন্তু ১ সেকেন্ড কি সত্যিই অনেক বেশি হতে পারে? নাকি এটা যৎসামান্য? চলুন, পরিসংখ্যান দেখা যাক!
১. সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণু ১ সেকেন্ড ৯,১৯২,৬৩১,৭৭০ বার স্পন্দিত হতে পারে।
২. ১ সেকেন্ডে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রায় ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ মিটার হয়।
৩. বিগ ব্যাং এর সময় যদি ১ সেকেন্ড এদিক-ওদিক হতো, তাহলে মহাবিশ্বর জন্ম হতো না।
৪. শোয়েব, স্টার্ক কিংবা বুমরাহ এর সর্বোচ্চ গতিসম্পন্ন বলগুলোর বেগ চিল ১ সেকেন্ডে প্রায় ৪২ মিটার।
৫. ১ সেকেন্ডে হৃৎপিণ্ড একের অধিক বার স্পন্দিত হতে পারে।
প্রথম ৩টা উদাহরণ দেখে মনে হচ্ছে যে ১ সেকেন্ড বুঝি বৃহৎ একটা সময়। শেষের ২টা দেখে মনে হচ্ছে যে ১ সেকেন্ডে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আপনাকে যদি ১ সেকেন্ড সময় দেওয়া হয়, তাহলে আপনি কি করতে পারবেন? সর্বোচ্চ যেটা সম্ভব হবে তা হলো আপনি “ এক হাজার এক” উচ্চারণ করতে পারবেন। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াল? একই সময় কখনো আলোর ঝলক, কখনো চোখের পলক!
গড়ের প্রতারণা
খ্যাতনামা লেখক নাসিম তালিব বলেছিলেন, “ঐ নদী কখনো পার হতে যাবেন না, যার গভীরতা গড়ে চার ফুট।“কোনো কোনো পাঠক এই কথা শুনে হয়ত বা মনে মনে গালমন্দ করবেন, কিন্তু তার কথায় গাণিতিক যুক্তি আছে। দেখুন, কথাটার মাঝে “গড়” শব্দটা রয়েছে। এর মানে নদীটির গভীরতা সবক্ষেত্রে ৪ ফুট নয়। কোথাও কোথাও ১-২ ফুট ও হতে পারে, আবার কোথাও ১৫-২০ ফুটও হতে পারে। তাই আপনি যদি দক্ষ সাতারু না হয়ে যদি ঐ নদীতে ডুব দেন, তাহলে কেল্লা ফতে!
আরেকটা মজার উদাহরণ দেওয়া যাক! বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৬৯.১১ মিলিয়ন। যদি জেলাভিত্তিক গড় হিসাব করা হয়, তাহলে প্রতিটি জেলায় গড়ে ২.৬৪ মিলিয়ন লোক বাস করে। অর্থাৎ গড়ের হিসেবে ঢাকায়ও ২.৬৪ মিলিয়ন লোকের বাস, যশোরেও ২.৬৪ মিলিয়ন লোকের বাস। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন, ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ২২ মিলিয়ন এবং যশোরের জনসংখ্যা প্রায় ০.৩ মিলিয়ন। তাহলে গড় কি প্রতারণা করল না?
গড়ের আরেকটা গন্ডগোল হলো মাথাপিছু আয়ের হিসাব। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৩০০০ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। আচ্ছা, একজন রিকশাওয়ালা মামা কি ৩০০০ মার্কিন ডলার উপার্জন করে? আবার সালমান এফ রহমান কিংবা সজীব ওয়াজেদ জয়ের উপার্জন কি মাত্র ৩০০০ মার্কিন ডলার? এই দুটো প্রশ্নেরই উত্তর “না”।
কল্পনা করুন, আপনি চা-কফি থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু সপ্তাহ শেষে শুক্রবার সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসে ৭ কাপ ব্ল্যাক কফি পান করলেন। গড়ের হিসাবে আপনি প্রতিদিন ১ কাপ কফি পান করেছেন। এতে আপনার তেমন কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা না। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? তাই গড়ে বিশ্বাস না করে গড়ের গ্যাঞ্জাম ভেদ করে বাস্তবতার প্যাচঁ খুলে তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
তাহলে পরিমাপের এসব ধোঁকাবাজি থেকে কি কি শিখলাম? একটা বস্তুর পরিমাপ ভিত্তিক বিশেষণ (ভারী, উঁচু, বড় ইত্যাদি) ব্যবহারের সার্থকতা ঐ বস্তুর প্রকৃতি,দশা ও অবস্থার উপর নির্ভর করে। আর গড়ের হিসেবে কোনো কিছুকে বিশ্লেষণ করলে সবক্ষেত্রে সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না, কিছু ক্ষত্রে বিশাল ত্রুটি হয়ে যায়। দিন শেষে এটাই ম্যাথ!
Leave a Reply