হে মন্ত শেষ হয়ে ক্রমশ আগমন ঘটছে শীতকালের। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ হলেও ছয়টা ঋতুর দেখা মেলে কেবল গ্রামে গঞ্জেই। ধুলোর শহরে যেন মাত্র দুটি ঋতুই ধরনা দেয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি কিংবা শেষদিক থেকে শুরু হয় শীতকাল। স্থায়ী হয় ফেব্রুয়ারি অবধি। বাদ বাকি বছর জুড়ে চলে গরমকাল। গ্রামে অবশ্য কুয়াশা ঢাকা শীত নামে শহরের কিছুটা আগেই। গরম শেষ হয়ে শীতের শুরুর সময়টায় কনকনে দাঁত লাগা শীত না পড়লেও এই সময়টাতে যেন কম বেশি সবারই সাধারণ সর্দি কাশি দেখা দেয়। কারো কারো আবার একেবারে ফ্লুও হয়ে যায়।
সাধারণ সর্দি-কাশি, ফ্লু কিংবা অন্যান্য ঊর্ধ্ব শ্বাসনালীর সংক্রমণ প্রায় সবই ঘটে ভাইরাসের কারণে। সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা আর ফ্লু এর লক্ষ্মণ প্রায় একই রকম। জ্বর, মাথা ব্যথা, সর্দি-কাশি, কফ প্রভৃতি। কারো কারোর ক্ষেত্রে আবার গলা ব্যথা কিংবা বিষণ্ণতাও দেখা দেয়। চিকিৎসকেরা সাধারণত সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা কিংবা ফ্লু হলে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ-ই দেন। কেননা চিকিৎসা শাস্ত্রে একটা কথা আছে,
“আপনি যদি ঠাণ্ডা লাগলে চিকিৎসা নেন তাহলে আপনার নিরাময় হতে সাত দিন সময় লাগবে। কিন্তু আপনি যদি কোন রকম চিকিৎসা গ্রহণ নাও করেন তাও আপনি এক সপ্তাহের মধ্যেই সেরে যাবেন”
তবে যাদের ফ্লু হয় এবং শরীরের অবস্থা ভালই বেগতিক হবার সম্ভাবনা বেশি যেমন গর্ভবতী মহিলা, বয়স্ক লোকজন কিংবা যাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা অ্যান্টিভাইরাল [১] নেবার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসব পেশাদার ডাক্তারি চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়াও মানুষজন সাধারণ জ্বর ঠাণ্ডা হলে ঘরোয়া ভাবে কিছু প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেমন গরম চা কিংবা স্যুপ, মধু, আদা কিংবা নানান ভেষজ ব্যবহার করা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরেই সাধারণ মানুষ এসব ব্যবহার করে আসছে। এগুলোর সবগুলোই সাধারণ ঠাণ্ডা কিংবা ফ্লু এর লক্ষণ গুলো কমাতে ভূমিকা রাখে। আজকে আলাপ করব যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসা এসব ঘরোয়া প্রতিকার পদ্ধতি গুলো নিয়ে।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে ভিটামিন সি আর কালোজাম
আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে ভিটামিন সি ভাল ভূমিকা রাখে। সাধারণ জ্বর ঠাণ্ডা হলে ভিটামিন সি জাতীয় ফলমূল কিংবা সবজি অসুস্থতার লক্ষণ গুলো কিছুটা হলেও কমাতে সাহায্য করে। কালোজাম [২] এক্ষেত্রে ভালই কার্যকরী। তবে গবেষণা বলে, সুস্থ থাকা অবস্থায় নিয়মিত ভিটামিন সি গ্রহণ করলে বেশি সুফল পাওয়া যায়। নিয়মিত ভিটামিন সি গ্রহণ করলে শরীরে সাধারণ জ্বর ঠাণ্ডা কম হয়।
গরম চা, স্যুপ, আদা এবং হলুদ
সাধারণ ঠাণ্ডা লাগলে কিংবা ফ্লু হলে অনেকের গলা ব্যথা শুরু হয়। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঊর্ধ্বশ্বাসনালীতে থাকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার ফলে অনেক সময় এমনটা হয়। এই অবস্থায় খাবার গলাধকরণ করা, পানি পান করায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। গলা শুকিয়ে যায়। গলার ভেতরে কফ জমে থাকে যা বাড়তি সমস্যার সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় গরম চা, স্যুপ কিংবা গরম পানি পান কিছুটা আরামবোধ করতে সাহায্য করে। গরম পানি অথবা চা-র সাথে আদা খেতে পারেন। চিকেন স্যুপ এর সাথেও যুক্ত করতে পারেন আদা। আদা প্রদাহ [৩] কমাতে বেশ ভাল ভূমিকা রাখে। হলুদও প্রদাহ কমাতে কার্যকরী হতে পারে। তবে ভালো ফল পেতে হলুদ তরকারির সাথে রান্না করে খেতে হবে। কেননা হলুদে থাকা কার্কিউমিন সহজে আমাদের দেহে শোষিত হয় না।
লবণ পানি এবং মধু
গলা ব্যথার সাথে সাথে গলায় কফ জমলে বাড়তি যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। উষ্ণ গরম [৩] লবণ জল দিয়ে গড়গড়া করলে এই অবস্থায় উপশম পাওয়া যায়। এক গ্লাস গরম জলে আধা চা চামচ লবণ মিশিয়ে নিতে পারেন। তারপর মুখে গরম লবণ জল নিয়ে গলবিল এর পেছনে গলায় কিছুক্ষণ রেখে গড়গড়া করতে পারেন। কিছু সময় গড়গড়া করে পানি ফেলে দিন। এতে গলার ভেতরে থাকা মিউকাস তথা কফ গুলো পরিষ্কার হবে। মাঝেমাঝে গরম লবণ জল দিয়ে কুলকুচিও করতে পারেন।
এতেও আরাম পাওয়া যায়। ডাক্তাররা মুখ এবং গলায় ব্যথা কমাতে গরম লবণ জল দিয়ে গড়গড়া করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটা গলার ভেতরে থাকা মিউকাস কমায়, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, বিভিন্ন অ্যালার্জেন দূর করে। লবণ পানি প্রদাহে আক্রান্ত টিস্যু গুলোকে উষ্ণ পানি দিয়ে আবরিত করে। ফলে আরাম বোধ হয়।
উষ্ণ লবণ পানির সাথে খানিকটা মধু মিশিয়ে নিতে পারেন। অথবা চা’র সাথেও মিশিয়ে নিতে পারেন। মধু গলার ভেতরের টিস্যুর প্রদাহ কমিয়ে আরাম বোধ হতে সাহায্য করে। একটা গবেষণা বলে রাতে ঘুমোতে যাবার সময় দুই চামচ মধু [৪] খেলে ঘুমের মধ্যে গলায় কফ জমে না এবং ভালো ঘুম হয়। তবে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের মধু খাওয়ানো উচিত না। কেননা এতে ইনফ্যান্ট বটুলিজম নামে একটা বিরল রোগ হবার রিস্ক থাকে।
নেটি পট, ভেষজ এবং বাষ্প
নাসা পথ ময়শ্চারাইজ রাখা ফ্লু থেকে রেহাই পাবার আরেকটা ভালো পন্থা। এক্ষেত্রে ঘরে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা যায়। হিউমিডিফায়ারে ভেষজ বাষ্প কিংবা উষ্ণ লবণ জল ব্যবহার করা যায়। গড়গড়ার চাইতে নাসা পথ উষ্ণ লবণ জল দিয়ে ভেজানো বেশি কার্যকরী। এতে শরীর থেকে মিউকাস আর ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া বেরিয়ে যায়। একটা গবেষণা [৫] বলে এই পদ্ধতি দ্রুত অসুস্থ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে ভূমিকা রাখে।
তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই পাতিত কিংবা ফুটানো পানি ব্যবহার করতে হবে। গবেষণা বলে ঘরের আদ্রতা ৪০ থেকে ৬০ [৬] শতাংশ রাখা ভালো। এতে রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ কম হয় এবং অসুস্থ হবার সম্ভাবনা কমায়। নাকে, ঘাড়ের নিচে কিংবা গলার নিচে মেন্থল মলম ব্যবহার করা যায়। মেন্থল শ্বাস-প্রশ্বাস আরামদায়ক করে। গরম জলে বিভিন্ন ভেষজ যেমন ইউক্যালিপটাস, থাইম ইত্যাদি ৫ থেকে ১০ মিনিট সেদ্ধ করে নাকের ভেতর বাষ্প নিতে পারেন। ফ্লু এবং সাধারণ ঠাণ্ডা লাগলে, মেন্থল, ইউক্যালিপটাস আর কর্পূর একসাথে গরম জলে সেদ্ধ করে এর নির্যাস ঘাড় আর বুকে ব্যবহার করা যায়। এতে ভালো ঘুম [৭] হয়।
সবশেষে, আপনার সাধারণ ঠাণ্ডা কিংবা ফ্লু হলে উপরের ঘরোয়া প্রতিকার পদ্ধতি গুলো ব্যবহার করতে পারেন। সবগুলোই সবার ক্ষেত্রে কার্যকরী নাও হতে পারে। এর কোনটার-ই তেমন ক্ষতিকারক প্রভাব নেই। তাই এক্ষেত্রে আপনি ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতি অনুসারে সবগুলোই চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যেই পদ্ধতিতে আপনি আরামদায়ক বোধ করছেন সেটা ব্যবহার করতে থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ
- What You Should Know About Flu Antiviral Drugs | CDC
- The Common Cold and Complementary Health Approaches: What the Science Says | NCCIH
- Anti-Oxidative and Anti-Inflammatory Effects of Ginger in Health and Physical Activity: Review of Current Evidence
- Which treatments provide the most relief for pharyngitis pain?
- Effect of Honey, Dextromethorphan, and No Treatment on Nocturnal Cough and Sleep Quality for Coughing Children and Their Parents
- A pilot, open labelled, randomised controlled trial of hypertonic saline nasal irrigation and gargling for the common cold | Scientific Reports
- Humidity as a non-pharmaceutical intervention for influenza A – PMC
- Prevention and treatment of the common cold: making sense of the evidence – PMC
- Zinc? Honey? Ginger? What Actually Helps When You Have a Cold or the Flu?
Leave a Reply