আমাদের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা হলো একইবয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশি পরিপক্ব। পরিপক্বতা (ম্যাচিউরিটি) বলতে সাধারণত মানসিক পরিপক্বতা (সাইকোলজিক্যাল ম্যাচিউরিটি) বোঝানো হয়। ম্যাচিউরিটিকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হয়। তবে বয়ঃসন্ধির সময় থেকে ব্যক্তিগত বিকাশের পরিপক্বতা মূলত তিন প্রকার, যাদের পার্থক্য স্পষ্ট। এগুলা হলো জৈবিক পরিপক্বতা (বায়োলজিক্যাল বা ফিজিক্যাল ম্যাচিউরিটি), মানসিক পরিপক্বতা (সাইকোলজিক্যাল বা মেন্টাল ম্যাচিউরিটি) এবং আবেগীয় পরিপক্বতা (ইমোশনাল ম্যাচিউরিটি)।
১) শারিরীক পরিপক্বতা বা বায়োলজিক্যাল ম্যাচিউরিটি
শারীরিক পরিপক্বতা হলো শারিরীক সক্ষমতা অর্জন এবং সকল অঙ্গের পূর্ণবিকাশ সম্পূর্ণ হওয়া। সাধারণত বয়সন্ধিকালেই আমরা শারিরীকভাবে পরিপক্ব হয়ে যাই (বেশিরভাগ দিক থেকে)। কিন্তু মানসিক ও আবেগীয় পরিপক্বতার এরকম কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। একজন মানুষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানসিক ও আবেগীয়ভাবে আরো পরিপক্ব হতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালে আসলে কী ঘটে?
এই পিরিয়ডে ছেলে এবং মেয়েরা তাদের বেশ বিস্তৃত শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তন লক্ষ করে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পূর্ণভাবে বিকশিত হয়। যৌনাঙ্গ বিকশিত হয়, উচ্চতা বাড়ে, দেহের আকার ও ভর বাড়ে, হরমোনের অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। ফলে ছেলে এবং মেয়েদের মানসিক পরিবর্তনও দ্রুতগতিতে ঘটে। তারা তাদের আশপাশের পরিবেশে অনেককিছু আবিষ্কার করতে শুরু করে।
মেয়েদের এই এডোলেসেন্স বা বয়ঃসন্ধিকাল এর সময়কাল সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর, যা ছেলেদের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৭ বছর। অর্থাৎ মেয়েরা যে ছেলেদের থেকে আগে শারিরীকভাবে পরিপক্বতা অর্জন করে তা স্পষ্ট। এই সময়ের পার্থক্য প্রায় দুই বছর। ছেলেদের তুলনায় আগে মেয়েদের শারীরিক পরিপক্বতা অনেকটুকু সম্পন্ন হয়ে যায়। হরমোনাল পরিবর্তন এবং মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে। ছেলেদের আগেই মেয়েদের মস্তিষ্কের স্নায়ুসংযোগ পুনরায় সংগঠিত হওয়া শুরু করে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের দূরবর্তী বিভিন্ন সংযোগ বা দূরের কোষ/টিস্যুর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয় এবং আবার নতুন সম্পর্ক গঠিত হয়।
এইসময় মেয়েরা কিছুক্ষেত্রে কগনেটিভ ও আবেগীয় পরিপক্বতায় একটু এগিয়ে থাকে। ছেলে মেয়ে উভয়ের বয়ঃসন্ধিকাল শেষ হওয়ার পর এটা অবশ্য প্রায় সমান লেভেলে চলে আসে আবারও।
এখানে লক্ষ করুন, বয়ঃসন্ধিকালে কিন্তু ছেলেমেয়েরা শারিরীকভাবে ‘সম্পূর্ণ’ পরিপক্বতা অর্জন করে না। শরীরের অল্প কিছু অংশ আরো পরে বিকশিত হয়। যেমন- মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ২৫ বছর বয়সের দিকে পুরোপুরি বিকশিত হয়।
মেয়েরা কেন ছেলেদের আগে শারীরিকভাবে পরিপক্বতা অর্জন করে?
বিবর্তনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে গেলে, মেয়েদের শরীর যতো তাড়াতাড়ি পুরোপুরি বিকশিত হবে ততো তাড়াতাড়ি সে বাচ্চা ধারণ এবং সুস্থভাবে বাচ্চা জন্মদানে সক্ষম হবে। ফলে প্রজননের হার বাড়বে এবং জনপুঞ্জের বৃদ্ধি ঘটবে। তাই মেয়েরা ছেলেদের আগেই জৈবিক এবং কিছু অংশে মানসিক ও আবেগীয় পরিপক্বতা অর্জন করে।
২) মানসিক পরিপক্বতা বা সাইকোলজিক্যাল ম্যাচিউরিটি
এটিকে মেন্টাল ম্যাচিউরিটি বা কগনেটিভ ম্যাচিউরিটিও বলা হয়। মানসিক পরিপক্বতা হলো কোনো ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া, অভিযোজনসহ আরো অনেকধরণের মানসিক সক্ষমতা। মানসিক পরিপক্বতার সংজ্ঞা দেশ, কাল, সমাজ, প্রচলিত রাজনীতি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ এর কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বলা কঠিন।
মানসিক পরিপক্বতার দিক থেকে কারা বেশি পরিপক্ব তা লিঙ্গের ভিত্তিতে সরলীকরণ করে বলা যায় না। অনেক ফ্যাক্টর আছে। যে ব্যক্তি বিভিন্ন ধরণের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছে বা যাকে বেশি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও অভিযোজনের ক্ষমতা বেশি হবে। অভিজ্ঞতা যতো বেশি, ব্যক্তি সাধারণত তত বেশি মানসিকভাবে পরিপক্ব হয়। এই অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে আবার যতো বেশি ভিন্নতা থাকবে ব্যক্তি তত বেশি পরিপক্ব হবে। কেউ যদি তার ক্লাসের ক্যাপ্টেন থেকে শুধু শৃঙ্খলা বজায়ে কাজ করে যায় তাহলে সে এই ক্ষেত্রে অনেক পরিপক্ব হয়ে উঠবে। কিন্তু তাকে যদি ক্লাসে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে বলা হয় তাহলে একেবারেই প্রথমবার করার কারণে তার এইক্ষেত্রে পরিপক্বতা কম থাকবে। সে ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কিভাবে কাজ করতে হয় তা শিখবে এবং ভবিষ্যতে আরো ভালো আয়োজন করতে পারবে। সহজভাবে বলতে গেলে মানসিক পরিপক্বতা মূলত এটাই, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা।
এখানে আসলে লিঙ্গ দিয়ে পার্থক্য টানা যায় না। এক্ষেত্রে সমবয়সী ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে কে বেশি ম্যাচিউরড সেই প্রশ্নটি-ই অবান্তর। তবে ছেলেদের বয়ঃসন্ধিকাল চলাকালীন, সমবয়সী মেয়ে যাদের বয়ঃসন্ধিকাল শেষ তারা মানসিক ও আবেগীয় পরিপক্বতায় কিছুদিকে এগিয়ে থাকে, যা কিছুসময় পরে আবার সমান লেভেলে চলে যায়।
৩) আবেগীয় পরিপক্বতা বা ইমোশনাল ম্যাচিউরিটি
কোনো পরিস্থিতিতে কোনো ব্যক্তির আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক আবেগ প্রকাশ করে পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়া-ই আবেগীয় পরিপক্বতা (ইমোশনাল ম্যাচিউরিটি)। সঠিক আবেগ কথাটি আসলে অস্পষ্ট, এখানে মূল বিষয় হলো আবেগ প্রকাশের মাধ্যমে পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়া। সার্বিকভাবে আবেগীয় পরিপক্বতায় লিঙ্গের ভিত্তিতে ভিন্নতা দেখা যায় না। অর্থাৎ সমবয়সী এবং প্রায় একইরকম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা আবেগীয়ভাবে প্রায় একইরকমের পরিপক্ব। তবে কয়েক প্রকারের আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রবিশেষে নারী এবং পুরুষরা একে অন্যের থেকে ভালো হয়। যেমন সিম্প্যাথি বা সমবেদনা জানানোর ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় বেশি আবেগীভাবে পরিপক্ব। চাপ সম্পর্কিত আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আবার ছেলেরা বেশি পরিপক্ব। এর কারণ হলো ছেলে এবং মেয়েদের সমাজে ভিন্নভাবে বেড়ে উঠা। সার্বিকভাবে ছেলে এবং মেয়েরা প্রায় সমান রকমের আবেগিক পরিপক্বতা-ই ধারণ করে।
সিদ্ধান্ত
সার্বিকভাবে দেখতে গেলে সমবয়সী নারী এবং পুরুষ সবরকমের পরিপক্বতার দিক দিয়ে প্রায় সমান ধরণের পরিপক্ব। নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে নারী এবং কিছু বিষয়ে পুরুষরা বেশি পরিপক্ব। বয়ঃসন্ধিকাল চলাকালীন সময়ে সমবয়সী মেয়েরা ছেলেদের থেকে আবেগিক ও মানসিকভাবে বেশি পরিপক্ব।
তথ্যসূত্র:
- What Is Emotional Maturity? 16 Key Traits and Tips for Development
- Scientists Identify Why Girls Often Mature Faster Than Boys | Psychology Today
- Brain connections may explain why girls mature faster — ScienceDaily
- Is there an evolutionary basis for why women mature faster than men? – Biology Stack Exchange
- New Research Shows How Evolution Explains Age Of Puberty — ScienceDaily
- Hormones and History: The Evolution and Development of Primate Female Sexuality – PMC
- Are Men And Women Equally Emotionally Intelligent?
Leave a Reply