দ্রবণ ভেদে রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিবিধি কেন পরিবর্তিত হয়?

রসায়ন ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাথে পরিচিত হবার পর থেকেই এটি আমাদের কাছে জাদুকরী হিসাবে ধরা দেয়। যেই জাদু আমাদের কাছে অতীন্দ্রিয়, বিস্ময়কর। যার কারণে একে বিজ্ঞানের চেয়ে জাদু হিসাবে উপভোগ করতেই আমরা মজা পাই। রসায়ন কাজ করে অণু-পরমাণুর মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসের আচরণ নিয়ে। যেই জগতে জাদুকরী ঘটনা হিসেবে আমরা যা উপভোগ করি তার বেশিরভাগই দুর্ঘটনা! পরমাণু তৈরির গল্পও এমন দুর্ঘটনার জন্যই। উত্তপ্ত প্রাচীন মহাবিশ্বে দুর্ঘটনা বসতই কিছু বাড়তি ইলেক্ট্রন ও অন্যান্য কণিকার জন্ম হয়েছিল। যা পরবর্তীতে একত্রে পরমাণু তৈরি করে। তার মানে এই না এই সবকিছুর ঘটনার মধ্যে  কোনো প্যাটার্ন নেই, ব্যাখ্যা নেই। নীল ডিগ্রেস টাইসনের একটা কথা মনে রাখা দরকার- আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা দেওয়ার ব্যাপারে প্রকৃতির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কৌতুহল কিংবা প্রয়োজনটা যেহেতু আমাদের, তাই দায়ভার এবং বাধ্যবাধকতাও আমাদের। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুধু অনু-পরমাণুর পরিবর্তন ছাড়াও পরিবেশ বা মাধ্যম পরিবর্তন করলে অনু-পরমাণুর গতিবিধি পুরো পালটিয়ে যায়। যেমন, 

CH3CH2Cl + NaOH (aq) → CH3CH2OH+ NaCl 

CH3CH2Cl + NaOH (alc) → CH2CH2 + H2O+ NaCl

ইথাইল ক্লোরাইড পানিতে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের সাথে বিক্রিয়া করলে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ইথাইল অ্যালকোহল, অথচ পুরোপুরি একই বিক্রিয়া পানির বদলে অ্যালকোহলে হওয়ার কারণে পাওয়া যাচ্ছে ইথিন! এটা কি আসলে জাদু নাকি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য? একটা কথা সবসময়ই মনে রাখা উচিত, এই মহাবিশ্বে কোনোকিছুই আপনিতেই হয় না। সবকিছুর পিছনে একটা কারণ থাকে, যাকে বলা হয় কার্যকারণ (Causality)। কোনোকিছুতে বাহ্যিক বল দিলে ত্বরণ হয়। এখানে “বল” হলো কারণ আর “ত্বরণ” হলো ফলাফল। কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে আগে তাকে অস্থিতিশীল করার জন্য একটা শক্তি দিতে হয় যার ফলশ্রুতিতে বিক্রিয়া হয়। তেমনি উপরের অদ্ভুত ঘটনার পিছনেও কারণ আছে।

এখন একটু উপরের ঘটনা নিয়ে ভাবা যাক। প্রথমে ইথাইল ক্লোরাইড কিভাবে কোনো দ্রবণে দ্রবীভূত হয় তা দেখি। ইথাইল ক্লোরাইডের গঠন হলো- 

এখানে কার্বনের চেয়ে ক্লোরিনের  তড়িৎ ঋণাত্মকতা বেশি। তাই সমযোজী বন্ধন ভেঙে কোনো দ্রবণে দ্রবীভূত হওয়ার সময় ক্লোরিন নিজের ইলেক্ট্রনসহ কার্বনের ইলেক্ট্রনও নিয়ে যায়। যার কারণে ঐকার্বন ধনাত্মক আয়নে পরিণত হয়।

 এখন উপরের বিক্রিয়ায় মূল উৎপাদ তৈরিতে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের হাইড্রোক্সিল আয়ন (OH-) মূল ভূমিকা রাখে। যেহেতু হাইড্রোক্সিল আয়ন একটা ক্ষার, তাই তার সাধারণ প্রবৃত্তি হলো হাইড্রোজেনের সাথে যুক্ত হয়ে পানি তৈরি করা। দেখ, উপরের বিক্রিয়ায় হাইড্রোক্সিল আয়ন দুইভাবে কার্বনের ধনাত্মক আয়নের সাথে যুক্ত হতে পারে- 

১. সে গিয়ে সরাসরি ধনাত্মক আয়নবিশিষ্ট কার্বনে যুক্ত হতে পারে। যার কারণে তৈরি হবে অ্যালকোহল জাতীয় পদার্থ বা ইথাইল অ্যালকোহল। অথবা…

২. সে গিয়ে সরাসরি অন্য কার্বনের হাইড্রোজেনকে সরিয়ে পানি গঠন করতে পারে। এই সময় হাইড্রোজেন বন্ধন ভাঙার ফলে কার্বন তার ইলেক্ট্রন নিয়ে ঋণাত্মক হয়ে যাবে। (ঠিক যে কারণে ক্লোরিন ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হয়েছিল)।  

এখন পাশাপাশি দুই কার্বনের একটাতে ইলেক্ট্রন বেশি বা ২টা অন্যটাতে কম বা ০ টা। তাই তারা ইলেক্টনদ্বয় শেয়ার করে বন্ধন গঠন করবে এবং মূল উৎপাদ হিসেবে ইথিন পাওয়া যাবে। 

কখন এই দুই ঘটনা ঘটবে সেটা তো বলা হয়েছে। এখন দেখি কেন ঘটবে?

কার্যকারণ

দ্রবণে দ্রবীভূত হওয়ার পর ইথাইল ক্লোরাইড ভেঙে যায়। তখন সে কি রূপ নিবে তা নির্ভর করে হাইড্রোক্সিল আয়নের উপর। পানিতে দ্রবীভূত থাকার সময় হাইড্রোক্সিল আয়নের চারপাশে পানির ধনাত্মক আয়ন এসে যুক্ত হয়। (যেহেতু পানি পোলার যৌগ, তাই এর আংশিক ধনাত্মক প্রান্ত থাকে)। হাইডোক্সিল আয়নের সাথে পানির আংশিক ধনাত্মক প্রান্ত যুক্ত হওয়ায় হাইড্রোক্সিল আয়ন অনেক বেশি স্থিতিশীল হয়ে পরে। যার কারণে কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধন ভেঙে হাইড্রোজেনের সাথে পানি তৈরি করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এর কারণ হিসেবে কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধনের মুনশিয়ানাও কাজ করে। তারা প্রায় কাছাকাছি তড়িৎ ঋণাত্মক হওয়ায় তাদের বন্ধন অনেক শক্তিশালী হয়, যা ভাঙতে অনেক শক্তির প্রয়োজন। আর পানিতে দ্রবীভূত হাইড্রোক্সিল আয়নের তত শক্তি থাকে না। ফলে সে সরাসরি গিয়ে ধনাত্মক আয়নের কার্বনের সাথে যুক্ত হয়ে ইথাইল অ্যালকোহল তৈরি করে। 

কিন্তু হাইড্রোক্সিল আয়ন অ্যালকোহলে দ্রবীভূত থাকলে সে এতটা স্থিতিশীল থাকে না। কারণ অ্যালকোহল থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন আয়ন পানির হাইড্রোজেন আয়নের মতো এত শক্তিশালী হয় না। যার কারণে হাইড্রোক্সিল আয়ন খুব একটা স্থিতিশীল হয় না এবং কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধন ভাঙার মতো শক্তি তার থাকে। তাই সে সহজেই পানি তৈরি করতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে উৎপন্ন হয় ইথিন। 

একটা প্রশ্ন এখনো থেকে যায়, অ্যালকোহল থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন আয়ন কেন পানির হাইড্রোজেন আয়নের মতো শক্তিশালী হয় না? এই উত্তর আপনিই খুঁজুন। মনে রাখবেন, প্রকৃতিতে কোনো কিছুই কার্যকারণ ছাড়া ঘটে না। আর আপনার কাছে বোধগম্য হয়ে ধরা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তার নেই। সে নিজের মতো গেম খেলে যাচ্ছে, আপনার বোঝা না বোঝাকে সে থোড়াই কেয়ার করে!

তথ্যসূত্রঃ

  • সিক্স ইজি পিসেস – রিচার্ড ফাইনম্যান (অনুবাদঃ উচ্ছ্বাস তৌসিফ)
  • ঝটপট জ্যোঃতিপদার্থবিজ্ঞান – নীল ডিগ্রেস টাইসন (অনুবাদঃ আবুল বাসার, উচ্ছ্বাস তৌসিফ) 
  • https://youtu.be/GaBg5zaptfk

ইংরেজিতে কন্টেন্ট রাইটার হয়ে গড়ে তুলতে পারেন নিজের ফ্রিল্যান্স-ক্যারিয়ার।

কীভাবে? দেখুন ফ্রি-মাস্টারক্লাস ভিডিও

ওয়াহিদুর রহমান মোহিন
আমি মোহিন। ভালোবাসি ভাবতে, নতুন নতুন বিষয় শিখতে এবং নিজের ভাবনাগুলো ছড়িয়ে দিতে।