“ভূমিকম্প” এক মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম। তুরষ্কের ঘটে যাওয়া বিশাল ভূমিকম্পের পর এই শব্দটা পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, ভূমিকম্প কেন হয়? কীভাবে এর মাত্রা পরিমাপ করা হয়? আর আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে এই দূুর্যোগের ঝু৺কি কতটুকু? এই সব প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর জানবো আজকের এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে। এই ব্লগটা মূলত শিক্ষার্থীদের জন্যই লেখা। এখন শুরু করা যাক!
প্রাথমিক ধারণা
ভূ-অভ্যন্তরের তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো থেকে তাপ বিচ্ছুরিত হয়। একটা সময়ে গিয়ে তাপের উত্তেজনায় সেখানে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়, যেয়া Incredible Hulk এর মতো আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর ফলে ঐ এলাকা কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দেয়। এই কাপুনিকেই আমরা ভূমিকম্প বলি, যা মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই থেমে যায়। তো, ভূ-অভ্যন্তরের যে স্থানে এই কাঁপা-কাঁপির প্রতিযোগিতা শুরু হয়, সেই জায়গাটাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র (Focus/Center) এবং ঐ বরাবর উপরের ভূ-পৃষ্ঠকে উপকেন্দ্র (Epicenter) বলে। কেন্দ্রে কম্পন সবচেয়ে তীব্র, উপকেন্দ্রে অপেক্ষাকৃত কম এবং উপকেন্দ্রের আশে-পাশের অঞ্চলে আরও কম মাত্রার কম্পন দেখা যেয়।
বিজ্ঞানীরা পৃথিবীকে কেটে-ছিঁড়ে কয়েক ভাগ করেছেন। ভাবছেন, এটা আবার কেমন কথা? আসলে গবেষকেরা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ভূ-ত্বককে কয়েকটি আলাদা আলাদা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করেছেন। এই কাটা-ছেঁড়াকে ‘ভৌগোলিক ব্যবচ্ছেদ’ বলা হয়। তো, এরকম প্রায় ৮টা বড় ক্যাটাগরি ও ৬টা ছোট ক্যাটাগরি রয়েছে। এগুলোকে ‘টেকটনিক প্লেট’ বলা হয়। এই প্লেট দ্বারা কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়ার পাত্রকে নয়, বরং ‘খন্ডিত অংশ’কে বোঝানো হয়।
যাহোক, যদি টেকটনিক প্লেটগুলোর বিচ্যুতি বা স্থানান্তর ঘটে, তবে ভূ-অভ্যন্তরের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয় মানে ঐ অংশ আলোড়িত হয়। ভূ-আলোড়নের ফলে ভূ-ত্বকের কোনো স্থানে শিলা ধসে পড়লে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। শুধু তা-ই নয়, যদি পাশাপাশি দু’টি প্লেট পরস্পরের সীমানা বরাবর তলদেশে প্রবেশ করে বা সরে যায়, তখন ভূমিকম্প দেখা দেয়। এছাড়াও ভূ-অভ্যন্তরে ফাটল সৃষ্টি, আগ্নেয়গিরির লাভার প্রচন্ড বেগে ভূ-অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসা, আকষ্মিক ভূ-আলোড়ন, নিউক্লীয় বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ, বড় আকারের কোনো গ্রহাণুর পতন ইত্যাদি কারণে ভূমিকম্প হতে পারে।
ধারণা মতে, গত ৪০০০ বছরে ভূমিকম্পের তান্ডবে প্রায় ১,৫০,০০০ লোক মারা গেছে। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামির আঘাতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
সিসমোমিটার ও রিখটার স্কেল
ভূমিকম্পের পরে সংবাদে বলা হয় যে এতো মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু এই মাত্রা কীভাবে পরিমাপ করা হয়? আসলে সিসমোমিটার নামের ঢোলের মতো একটা যন্ত্র দিয়ে ভূমিকম্পের এই মাত্রা পরিমাপ করা হয়ে থাকে। এই কম্পনের মাত্রা দিয়ে যে লেখচিত্র তৈরি করা হয়, তাকে বলা হয় সিসমোগ্রাফ। এই রেকর্ড হওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ও স্থায়িত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়।
ভূমিকম্পের এই মাত্রা রিখটার স্কেল নামের কিছু একটা দিয়ে নির্ধারণ করা হয়। মার্কিন ভূকম্পবিদ চার্লস এফ. রিখটার ১৯৩৫ সালে এই স্কেল উদ্ভাবন করেন। রিখটার স্কেলে ০ থেকে ১০ মাত্রা পর্যন্ত মাপা যায়। এটি একটি ১০ ভিত্তিক লগারিদমীয় পরিমাপ। এর সহজ মানে হলো এই পরিমাপে যেকোনো সংখ্যার ভূমিকম্প পূর্ববর্তী সংখ্যার চাইতে ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী। যেমনঃ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী। আবার ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে ১০০ গুণ শক্তিশালী।
একটা কথা বলে রাখা ভালো, রিখটার স্কেল ছাড়াও ভূমিকম্প মাপার জন্য আরও অনেক পদ্ধতি রয়েছে। তবে বিশ্বজুড়ে এটাই সবচেয়ে ব্যবহৃত।
আমাদের বাংলাদেশ
ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে চিপায় ফেলে দিয়েছে। আমরা ইন্ডিয়ান প্লেট ও মিয়ানমার সাব-প্লেটের মাঝখানে অবস্থিত। একারনে বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল (Earthquake Prone Region)। ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও পার্শ্ববর্তী বিশেষ করে উত্তর ও পূর্বদিকে ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো যথেষ্ঠ বিচ্যুতি রয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে চা-বাগানের সিলেট।
১৯৮৯ সালে ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল গুলোকে চিহ্নিত করে একটি মানচিত তৈরি করে, যেটি থেকে বলা যায়, সুষ্ঠ পদক্ষেপের অভাবে ভূমিকম্পের তান্ডবে অনেক বড় বড় জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের ডাউকি ফল্টে ৮.২ মাত্রার ভূমিকম্পও হতে পারে। আর এর ক্ষয়-ক্ষতি হবে তুরষ্কের চেয়েও বহুগুণ। একারণে বিল্ডিং নির্মাণে স্ট্রাকচার ও ডিজাইন তৈরির সময় ‘National Building Code’ অনুসরণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অবলম্বনের মাধ্যমে সচেতন হতে হবে। যদি ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমাতে হয়, তাহলে ডজন খানেক পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
আজকের প্রবন্ধে আমি মাটি কাঁপিয়েছি, পৃথিবীকে প্লেট বানিয়েছি এবং বিল্ডিং তৈরি করেছি। তো, আজ বিল্ডিং তৈরি করেই বিদায় নিচ্ছি। আল-বিদা!
Leave a Reply