দ্বিপদী বিস্তৃতি কোন কাজে লাগে?

গণিত ও মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতা

গণিত সম্ভবত মানুষের ইতিহাসের সেরা কিছু আবিষ্কারের মধ্যে একটা। এর জন্ম হয়েছিল নিতান্ত ব্যবসায়িক চাহিদা ও গণনার দুর্বধ্যতা মেটানোর জন্য। আদিকালে গণনা করার জন্য মানুষ গণিত আবিষ্কার করে, সংখ্যা আবিষ্কার করে। যেই সংখ্যা আবিষ্কারকে মানব সম্প্রদায়ের দারুণ একটা আবিষ্কার হিসেবে ভাবা হয়। কেন বলুন তো দেখি? সেই সাথে সাথে বড় হওয়ার সাথে সাথে আমরা গণিতের অনেক শাখার সাথে পরিচিত হই। আর তখনি প্রশ্ন আসে এর কাজ কি?

তেমনি একটি শাখা হলো দ্বিপদী বিস্তৃতি। দ্বিপদী বিস্তৃতি শেখার প্রথম প্রথমে আমাদের শুধু একটা ধারণাই কাজ করে এটা হয়ত বড় বড় গাণিতিক সমস্যা সমাধানে কাজে লাগে। কিন্তু গণিতের সমস্যার বাইরে কি এর কোনো কাজ নেই? এটা কি গাণিতিক সমস্যার বাইরে কাজে লাগে না? যদি কাজে না-ই লাগে তবে এটা শিখে কি লাভ? হ্যাঁ, লাভ… লাভের প্রশ্ন জাগবে কারণ আমরা সবকিছুতে লাভ খুঁজি। আর এই কারণে আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যটাও অনেক সময় ঠুনকো হয়ে যায়। কারণ লাভ ছাড়া আসলে আমরা কোনো কিছু করি না। আমরা শিক্ষা অর্জনের পিছনে লাভ খুঁজি। কিন্তু শিক্ষা যেভাবে আমাদের ভাবনার উন্নতি করে সেটা কি আমরা জাগতিক কিছু দিয়ে বিচার করতে পারব! গণিত নিয়ে জি. এইচ হার্ডি বলেন–

যা মানুষের প্রয়োজনীয় বা দরকারি তা গৌণ গণিত। এর বিপরীতে যা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে সংযুক্ত করে, যা গুরুত্বপূর্ণ ধারণাকে সংযুক্ত করতে পারে, সর্বোপরি যা একজন খাঁটি গণিতবিদকে আনন্দ দেয় তাই উচ্চতর গণিত

এখন মূলত এই গণিতের আনন্দ নিয়েই কথা বলব। কিন্তু একটা কথা বলে রাখি, বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপদী বিস্তৃতির প্রয়োগ আছে। যেমন অর্থনীতিবিদরা প্রায়-ই এই গণিতের দ্বারস্থ হন। আর্কিটেক্টরা বিভিন্ন ডিজাইন বানানোর সময় এই দ্বিপদী বিস্তৃতি ব্যবহার করে থাকেন।

দ্বিপদী বিস্তৃতির জ্যামিতি

দ্বিপদী বিস্তৃতি নিয়ে অনেকে গণিতবিদ-ই ভাবতেন। এর মধ্যে ইউক্লিডের কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দুইটি সংখ্যার বর্গ নিয়ে তার এলিমেন্টসে জ্যামিতিক প্রমাণ করেছেন। এটি (a+b)^2 এর সূত্রের জ্যামিতিক রূপ। তখন তো আর বীজগণিত ছিল না, তাই তিনি এই সূত্রকে একটা দ্বিমাত্রিক বর্গের সাথে চিন্তা করে কাজটা করেছেন। এই যে চিন্তাটা, এটা দিয়ে কিন্তু সুন্দর আরো কিছু চিন্তা করা যায়!

যেমন আমরা এই চিন্তার সূত্র ধরে অন্যান্য মাত্রার কাঠামো কেমন হবে সেটা চিন্তা করতে পারি। (a+b)^0 কে শূন্য মাত্রা (বিন্দু) হিসেবে চিন্তা করতে পারি, (a+b)^1 কে একমাত্রা (একটা রেখা) হিসেবে চিন্তা করতে পারি, (a+b)^2 কে দ্বিমাত্রিক (যেমন ইউক্লিড চিন্তা করেছিলেন, দ্বিমাত্রা হবে শুধু একটা সার্ফেস। এটার কোনো উচ্চতা হবে না ) হিসেবে ভাবতে পারি, (a+b)^3 ত্রিমাত্রিক(আমাদের পরিচিত জগৎ) ধরতে পারি। (a+b)^4 কে? এখানেই আসলে মজা। এটাকে আমরা ভাবতে পারি চতুর্মাত্রিক কাঠামো হিসেবে হিসাবে! সাধারণত কোনো প্রাণী যেই মাত্রায় বসবাস করে সে তার উপরের মাত্রা সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে না। দ্বিমাত্রিক প্রাণী যদি থাকত, তাহলে তারা আমাদের সম্পর্কে চিন্তা করতে পারত না। আর গণিতের মাহাত্ম্য এখানেই। আমরা আমাদের উপরের মাত্রার কাঠামো সম্পর্কে চিন্তা করতে পারছি। তাহলে দেখি চতুর্মাত্রিক কাঠামো কেমন হয়–

আমরা এই কল্পনাটা করবো বিন্দু দিয়ে। কেউ চাইলে কোণ দিয়েও করতে পারেন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে চিন্তাটা যেন শুধু কোণ দিয়ে হয়। হযবরল না হয়ে যায়। আর আরেকটা সন্দেহ থাকতে পারে, সেটা হলো আইন্সটাইন তো বলেছেন, এই মহাবিশ্ব চতুর্মাত্রিক তাহলে কেন আমরা চতুর্মাত্রা নিয়ে চিন্তা করতে পারব না। আইন্সটাইন আমাদের যেই ত্রিমাত্রিক কাঠামো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা এটাকে কিন্তু চতুর্মাত্রিক বলেন নি। তিনি এই কাঠামোর সাথে যোগ করেছেন সময়। তাই চতুর্মাত্রিক বলেছেন। কেন সময়? কারণ আজকে আমি যেই ঘরে বসে লিখছি কয়েক বছর পর এর অস্তিত্ব না-ই থাকতে পারে, কিংবা হয়ত অতীতে এর অস্তিত্ব ছিল না। এখন আছে। এইভাবে চিহ্নিত করার জন্য সময় ধরেছেন।

আমরা এখন চতুর্থ মাত্রার সন্ধান করি

আমরা জানি যে একটা বিন্দু দিয়ে বোঝায় শূন্য মাত্রা। কারণ এটা ডানে বামে উপরে কোথাও যেতে পারে না। এর জীবনের বৈচিত্র্য শেষ! আবার দুইটা বিন্দু যদি পাশাপাশি বসানো হয় তাহলে এক মাত্রায় থাকে দুইটা বিন্দু। (আমরা চিন্তা কিন্তু প্রান্ত বিন্দু দিয়ে করছি। সাবধান!) একটা রেখার সাথে যদি আরো কয়েকটা রেখা লাগিয়ে দেই, তাহলে হয়ে যাবে দ্বিমাত্রিক তল। যেমন, বর্গ। আর সেখানে ৪টা প্রান্ত বিন্দু। ঐ বর্গটার উপরে যদি আরো কয়েকটা বর্গ রেখে দেওয়া হয় তাহলে হয়ে যাবে ত্রিমাত্রিক কাঠামো। যার ৮ টা প্রান্ত বিন্দু। তাহলে চার মাত্রায়?

পুরো চিত্রটা আবার দেখি,

শূন্য মাত্রা — ১ টা প্রান্তবিন্দু

এক মাত্রা — ২ টা প্রান্তবিন্দু

দ্বিমাত্রায় — ৪ টা প্রান্তবিন্দু

ত্রিমাত্রায় — ৮ টা প্রান্তবিন্দু

দ্বিপদী বিস্তৃতির সূচক বাড়ার সাথে সাথে যেভাবে জ্যামিতিক আকৃতির পরিবর্তন হয়।

দেখো মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে প্রান্তবিন্দু ২ এর গুণিতক আকারে বাড়ছে। এটা 2^n হিসেবে লেখা যায়। তাহলে চতুর্থ মাত্রার কাঠামোতে ১৬ টা প্রান্তবিন্দু থাকবে। আমরা যদি এমন কোনো কাঠামো আঁকতে পারে যাতে ১৬ টা প্রান্তবিন্দু তাহলে সেটা হবে চতুর্থ মাত্রার কাঠামো। এখন দেখেছো কীভাবে গণিত আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা দূর করেছে! অথচ আমরা পড়ে থাকি স্বার্থ আর লাভ নিয়ে। এখানে একটা বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার। আমরা আসলে ত্রিমাত্রিক জগতের উপরের জগৎ সম্পর্কে কিছু জানি না। কিন্তু আমরা সাধারণ ইউক্লিডীয় জ্যামিতি থেকে জানি যে কয়েকটা বিন্দুকে একত্র করলে একটা রেখা পাই, আবার কয়েকটা রেখাকে একত্র করলে পাই দ্বিমাত্রিক তল বা চতুর্ভুজ, কয়েকটা চতুর্ভুজকে একত্র করলে পাই ঘন এভাবে আমাদের সাধারণ জ্যামিতিক জ্ঞান থেকে অন্যান্য মাত্রার কাঠামো সম্পর্কে ধারণা নিতে পারি (সুনিশ্চিত হতে পারি না)।

কিন্তু গণিত না থাকলে আমরা এই ধারণাটাও পেতাম না। আর এটাই গণিতের মাহাত্ম্য!

তথ্যসূত্রঃ

ইংরেজিতে কন্টেন্ট রাইটার হয়ে গড়ে তুলতে পারেন নিজের ফ্রিল্যান্স-ক্যারিয়ার।

কীভাবে? দেখুন ফ্রি-মাস্টারক্লাস ভিডিও

ওয়াহিদুর রহমান মোহিন
আমি মোহিন। ভালোবাসি ভাবতে, নতুন নতুন বিষয় শিখতে এবং নিজের ভাবনাগুলো ছড়িয়ে দিতে।