পদার্থবিজ্ঞানের বাস্তবমুখী গাণিতিক আর জীববিজ্ঞানের বিচিত্র সব ব্যাপার একত্রিত হলে সেই জিনিসটা কতটা ইন্সটারেস্টিং হতে পারে সেটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? জীববিজ্ঞান আর রসায়ন মিলে হয় প্রাণরসায়ন (Biochemistry), ভূগোল আর জীববিজ্ঞান মিলে হয় জীবভূগোল (Bio-geography)। একইভাবে জীববিজ্ঞান আর পদার্থবিজ্ঞানের আলোচনার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে জীবপদার্থবিজ্ঞান (Biophysics)। কখনো কি ভেবে দেখেছো যদি পদার্থবিজ্ঞানের বাস্তবমুখী সূত্র আর জীববিজ্ঞানের বিচিত্র সব কিছু মিলে নতুন আরেকটি বিষ্ময় তৈরি করে, তাহলে কেমন হবে? আজ সেই বিষ্ময় নিয়েই কথা হবে।
জীবপদার্থবিজ্ঞান (Biophysics) মূলত জৈবিক কার্যক্রম বোঝার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে। এর লক্ষ্য প্রধানত কোন জীবের মৌলিক স্তরের গঠন, মিথস্ক্রিয়া এবং তার সমগ্র জৈবিক কার্যক্রমের ব্যাপারে জানা। জীবপদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা রোগ প্রতিরোধ ও ওষুধের অগ্রগতি সাধনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও বৈশিষ্ট্যকে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করাই বায়োফিজিক্সের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আসলে এটি জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে।
বায়োফিজিক্সের একটি চমৎকার বাস্তব উদাহরণ হলো ডিএনএ এর গঠন আবিষ্কার। ওয়াটসন এবং ক্রিক ডিএনএ এর গঠন এবং এটি কিভাবে জীবনের নীলনকশার মতো কাজ করে তা আবিষ্কার করেন। আবার জীবপদার্থবিজ্ঞানের সহায়তায় বর্তমানে ডিএনএ এর ডেটা বিশ্লেষণ করে বিপুল পরিমাণ তথ্য আমরা জানতে পারি। এক্স-রে মেশিনে আলো, আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে শব্দ, ইসিজিতে বৈদ্যুতিক ক্রিয়া এবং রেডিওথেরাপিতে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রয়োগ-সবখানেই রয়েছে বিজ্ঞানের প্রাচীনতম শাখা পদার্থবিজ্ঞানের উপস্থিতি। অর্থাৎ, বায়োফিজিক্সকে বাদ দিয়ে এ যুগের আধুনিক চিকিৎসা মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়বে।
এখানেই শেষ নয়। বর্তমানে বায়োফিজিক্স ব্যবহার করে “ন্যানোচিকিৎসা” নামে নতুন এক ধরণের চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে উঠছে। এটি অনেকাংশেই পদার্থবিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল, তবে কিছু অংশে রসায়নের সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। ন্যানোচিকিৎসাকে সফল ও উন্নত করতে হলে আমাদেরকে সবার আগে বিভিন্ন ধরণের ন্যানো পার্টিকেল বা কণার গতি-প্রকৃ্তি সম্পর্কে জানতে হবে। আর এজন্য যেতে হবে ফিজিক্সের কাছে। বর্তমানে এ. এফ. এম যন্ত্রের মাধ্যমে কয়েক ন্যানোমিটার দৈর্ষের অণুকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। একই ধরণের অণুর ভর নির্ণয় করতে ন্যানোক্যান্টিলিভার ব্যবহৃত হয়। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে হয়ত ব্যবহৃত হবে ন্যানোশেল বিশিষ্ট ড্রাগ, যা কার্যক্ষম করতে প্রয়োজন ইনফ্রারেড রে বা অবলোহিত রশ্মির প্রয়োগ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সামনের দিনে ফিজিক্সের কিছু চমকপ্রদ সূত্রের মাধ্যমে একসময় ন্যানোচিকিৎসার জগতে অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হবে।
কোষাভ্যন্তরে ঠিক-ঠাক মতো রাসায়নিক বিক্রিয়া চলতে থাকলে এর ভেতরের এনট্রপি হ্রাস পায় বা অপরিবর্তিত থাকে। তবে এক্ষেত্রে বাইরের এনট্রপি বৃদ্ধি পায়। এনট্রপি হলো কোনো একটি বস্তুর গাঠনিক উপাদানগুলোকে যে কয়ভাবে পরিবর্তন করলে মূল বস্তুর সিস্টেমে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না, তাকে বা ঐ পরিমাণকে এনট্রপি বলে। ব্যাপারটা কিছুটা গণিতের চক্রক্রমিক রাশির মতো। আর এটি থার্মোডিনামিক্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পদার্থবিজ্ঞান আমাদেরকে জানিয়েছে, এনট্রপি বাড়লে কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। আর এই নীতি রক্ষা করতেই কোষের ভেতরে এনট্রপি অপেক্ষাকৃত কম থাকে।
পুরো মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা করছে, তার প্রায় অধিকাংশই জীবপদার্থবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। হৃৎপিন্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো প্রকার বহিঃউদ্দীপনা ছাড়াই বৈদ্যুতিক সিগন্যানের মাধ্যমে পাম্প করে পুরো দেহে রক্ত সরবরাহ করছে। আর এর ফলে সেন্সরি সিস্টেম বা সংবেদী তন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হচ্ছে। এভাবে পুরো দেহের ভেতরে পালিত হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের সংবিধান।
আমরা জানি রক্ত একটি তরল যোজক কলা, যেটি বিভিন্ন নালিকার মধ্য দিয়ে নিখুঁতভাবে পরিবাহিত হয়। একইভাবে উদ্ভিদ দেহে পানি ও পুষ্টি উপাধান পরিবাহিত হয়। এই বিষয়টিকে পদার্থবিজ্ঞানের “Fluid Dynamics” নামক ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। সালোকসংশ্লেষণ বা ফটোসিনথেসিসের সময় উদ্ভিদ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় পদার্থের মধ্যে সৌরশক্তিকে স্থিতি শক্তিরূপে জমা করে রাখে। আবার খাদ্য গ্রহণ ও শ্বসনের মাধ্যমে আমাদের শরীরের রাসায়নিক শক্তি তাপশক্তি ও যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আর এখানে অনুসরণ করা হয় আমাদের অতি পরিচিত চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের শক্তির নীতি।
আমরা দেখলাম ক্ষুদ্র কোষ থেকে বৃহৎ দেহ সবখানেই রয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র, পদ্ধতি আর তত্ত্ব। তাই এ বিষয়ে আলোচনা করাটা এতো সহজ নয়। একারণেই Biophysics নামে একটা আলাদা শাখাই গড়ে উঠেছে। এখন স্বাভাবিকভাবে মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে, এতো বিশাল শাখায় কি বাঙালিদের কোন অবদান নেই?
জগদীশ চন্দ্র বসু উদ্ভিদের বৃদ্ধি রেকর্ড করার জন্য ক্রেস্কোগ্রাফ আবিষ্কার করেন। এছাড়াও উদ্ভিদের খুব সূক্ষ্ম নাড়াচাড়ার বিষয়েও তিনি ধারণা দিয়েছেন। আগে মনে করা হতো যে বিভিন্ন উদ্দীপনার প্রতি উদিদের সাড়া দেওয়ার ধরণ রাসায়নিক প্রকৃ্তির। কিন্তু এই বাঙালি বিজ্ঞানী দেখান যে এটি আসলে বৈদ্যুতিক প্রকৃ্তির। এছাড়াও ড. শুভ রায় প্রতিস্থাপনযোগ্য কৃত্রিম কিডনি উদ্ভাবন করেন, যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় পদার্থবিজ্ঞানের যান্ত্রিক নিয়ম-নীতি।
আজ এ পর্যন্তই। সংক্ষেপে জীববিজ্ঞান আর পদার্থবিজ্ঞানের বন্ধুত্বের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সাম্প্রতিক বিজ্ঞানকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে জীবপদার্থবিজ্ঞান।
তথ্যসূত্রঃ
১. Biophysics-Biology Dictionary
২. Atomic Force Microscopy
৩. এনট্রপি-টেন মিনিট স্কুল
৪. What Is Fluid Dynamics?
৫. Jagadish Chandra Bose: Biography & Contributions
৬. The Kidney Project
Leave a Reply