অজানা জীববিজ্ঞানের যত ভুল ধারণা

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

মহাবিশ্বের সবচেয়ে জটিলতম বিষয়গুলোর একটি হলো জীববিজ্ঞান-এই ধারণাটা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে গেছে। এই ধারণার পেছনে একটা না, বহু কারণ রয়েছে। প্রথমত, জীববিজ্ঞানের কাজই জটিল সব কাঠামো নিয়ে কাজ করা, যেগুলোর অধিকাংশই অঙ্ক কষে সমাধান করে ফেলার মতো নয়। দ্বিতীয়ত, এর বিভিন্ন বিষয়ের (জিনোম, শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, আচরণ ইত্যাদি) ভেলকি এখনো পুরোপুরি উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তাই অনেক “কেন” এর উত্তর অস্পষ্ট।

তৃ্তীয়ত, প্রতিদিনই জীববিজ্ঞানের পৃষ্ঠাগুলোর সংস্করণ ঘটছে। জীববিজ্ঞানের এতোসব মারপ্যাঁচের কারণে শিক্ষার্থীরা একটা বিষয়ের পুরো রহস্যটা জানতে পারে না, অনেকক্ষেত্রে জানতে দেওয়া হয় না। আবার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে অনেকেই নতুন জীববিজ্ঞানের সাথে আলিঙ্গন করতে পারে না।

এই প্রবন্ধে আমি এমনই কিছু বিষয়ের কথা বলব, যেগুলো নিয়ে আমাদের মধ্যে ভুল ধারণা বা জানার কমতি রয়েছে। আর এগুলো কিন্তু বায়োলজির ব্যাপার-স্যাপার!

প্লাজমোডিয়াম বিভ্রাট

কবে জানি একজন বলছিল, “প্লাজমোডিয়াম এমন এক ধরনের জীবাণু, যেটি মেরুদন্ডী প্রাণী ও কীটপতঙ্গের মধ্যে পরজীবী হিসেবে বাস করে।“ কথাটা শোনার পরে আমার মাথায় প্লাজমোডিয়ামের শ্রেণিবিন্যাস নেচে উঠলো। এরপর আমি তাকে বললাম, “প্লাজমোডিয়াম তো কোনো জীবাণু নয়।“ কথাটা শোনার পরে ছেলেটা আকাশ থেকে পড়ে বলল, “কী বলেন, ভাইয়া? এই অণুজীবের কারণেই তো ম্যালেরিয়া হয়।“

আসলে প্লাজমোডিয়াম (Plasmodium) Plasmodiidae গোত্রের একটি গণ (Genus)। এই গণের পেটের ভেতরে প্রায় ২০০টি প্রজাতি (Species) রয়েছে। প্রতিটি প্রজাতি একেকটি জীবাণু, কিন্তু প্লাজমোডিয়াম কোনো জীবাণু নয়, এটি একটি ট্যাক্সোনমিক ইউনিক বা শ্রেণিবিন্যাসগত একক।

ঝামেলা এখানেই শেষ নয়। NCTB প্রদত বইয়ের কারণে স্কুলের শিক্ষার্থীদের একটা ধারণা আছে যে শুধুমাত্র Plasmodium vivax এর কারণেই ম্যালেরিয়া হয়। কিন্তু, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্লাজমোডিয়ামের ৫টি প্রজাতি রয়েছে, যারা ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ীঃ Plasmodium falciparum, Plasmodium vivax, Plasmodium ovale, Plasmodium malariae এবং Plasmodium knowlesi। তাহলে শুধুমাত্র P.vivax বাবাজীর কারণেই ম্যালেরিয়া হয় না। আর এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো P.falciparum, যেটার কারণে আজ পুরো আফ্রিকা ম্যালেরিয়ায় বিধ্বস্ত।

এবার প্লাজমোডিয়ামের কাহিনী ক্লিয়ার?

ডিএনএ এর আকার

আমরা জানি যে ওয়াটসন ও ক্রিক ১৯৫৩ সালে DNA Double Helix Model প্রদান করেন, যেখান থেকে জানা যায় যে ডিএনএ দ্বিদূত্রক। কিন্তু অনেকেরই ধারণা, ডিএনএ কেবলমাত্র দ্বিসূত্রকই হয়ে থাকে। তবে এটি একসূত্রক বা ত্রিসূত্রকও হতে পারে। যেমনঃ কিছু ভাইরাসে একসূত্রক ডিএনএ আর আমাদের দেহে ত্রিসূত্রক ডিএনএ সচরাচর পাওয়াই যায়।

আবার সব ডিএন কিন্তু সর্পিলাকার (Helical) হয় না। কিছু কিছু ডিএনএ দেখতে বিদঘুটে হয়ে থাকে যেমনঃ Tetraplex DNA। এধরণের ডিএনএ চারটি স্ট্র্যান্ড নিয়ে তৈরি হয়। ব্যাকটেরিয়ার আসল ডিএনএ আবার প্যাঁচায়ে চক্রাকার রূপ ধারণ করে। আবার প্লাজমিডে নেই কোনো হেলিক্স, এই ডিএনএ সিম্পল গোলকের মতো কিছুটা! জীবজগতে এরকম আরও বহু বৈচিত্র্যময় ডিএনএ খুঁজে পাওয়া যায়।

অ্যাপেনডিক্স কি অকার্যকর?

একটা সময় মনে করা হতো যে ম্যানবদেহের অ্যাপেনডিক্স nonfunctional বা অকার্যকর। আর এখনও আমরা অনেকে মনে করি যে অ্যাপেনডিক্স কোনো কাজের নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা একে “গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকআপ” বলে অভিহিত করেছেন। নতুন একটি গবেষণা বলছে যে এই অংশটি অন্ত্রে বসবাসকারী উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে রক্ষা করে। এটি উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে ধারণও করে। অ্যাপেন্ডিক্সের ইমিউন টিস্যুতে কোলনের তুলনায় ইমিউনোগ্লোবিন IgA এবং IgG উৎপাদনকারী ইমিউনোসাইটের ঘনত্ব বেশি থাকে। একারণে এটি অন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করতে সক্ষম। সুতরাং, আজ থেকে আপনি এপেন্ডিক্সকে আর অপ্রয়োজনীয় বা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়।

লালাগ্রন্থি আসলে কয়টা?

মাধ্যমিকের একজন জীববিজ্ঞান জানা শিক্ষার্থীকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, “তোমার দেহে কয় জোড়া লালাগ্রন্থি আছে?” তাহলে সে চোখ বন্ধ করে জবাব দিবে, “তিন জোড়া”। বাংলাদেশের ৯৯% জীববিজ্ঞানের শিক্ষকও এই উত্তরকে সমর্থন করবে। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে যে উত্তরটা সম্পূর্ণ ভুল। হুম, ঠিকই শুনেছেন।

আপনার-আমার দেহে আসলে চার জোড়া লালাগ্রন্থি রয়েছেঃ প্যারোটিড, সাব-ম্যান্ডিবুলার, সাব-লিঙ্গুয়াল এবং টিউবারিয়াল। অর্থাৎ নতুন আবিষ্কৃত লালাগ্রন্থিটি হলো Tubarial Salivary Gland, যেটা ২০২০ সালে নেদারল্যান্ডস ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের একদল গবেষক আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে আমাদের অবহেলার কারণে এই লালাগ্রন্থি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

আবারও ডিএনএর ক্যাচাল

ডিএনএতে নাইট্রোজেনাস বেস বা নাইট্রোজেনঘটির ক্ষারক কয়টা থাকে? নিশ্চয়ই আপনি বলবেন যে চারটিঃ A(অ্যাডেনিন), T(থায়মিন), C(সাইটোসিন) এবং G(গুয়ানিন)। কিন্তু মজার বিষয় হলো, কিছু ভাইরাসে A(অ্যাডেনিন) এর জায়গায় Z (২-অ্যামিনোপিউরিন) থাকতে পারে। এই অ্যামিনোপিউরিন অ্যাডেনিনের মতো থায়মিনের সাথে বন্ধন গঠন করতে পারে।

আচ্ছা, বন্ধনের কথা যখন আসলোই, তখন আরেকটা কথা বলি। আমরা তো জানি, সাধারণত অ্যাডেনিন থায়মিন বা ইউরাসিলের সাথে এবং গুয়ানিন সাইটোসিনের সাথে বন্ধন গঠন করে। কিন্তু এখানেই কী শেষ? না, মোটেও না। প্রকৃতিতে গুয়ানিন আর ইউরাসিলের মধ্যেও বন্ধন গঠিত হয়, যাকে ওয়াবল পেয়ারিং (Wobble pairing) বলে। এ ধরণের পেয়ারিং যে শুধু গুয়ানিন আর ইউরাসিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সেটা ভাববেন না। হাইপোএক্সেন্থাইন নামক যৌগের সাথে ইউরাসিল, অ্যাডেনিন এবং সাইটোসিনের বন্ধনকেও ওয়াবল পেয়ারিং বলা হয়।

অঙ্গাণু নাকি জীবাণু?

আপনার দেহের কোষের মধ্যে এক ধরণের জীবাণু আছে, যেটাকে হয়ত আপনি কোষীয় অঙ্গাণু হিসেবে জানেন। আর আপনার ছাদের বা বাড়ির পাশের গাছটাতে এরকম জীবাণু রয়েছে দু’ধরণের, যেগুলোকেও আপনি হয়ত কোষীয় অঙ্গাণু হিসেবে জানেন। কী? অবাক লাগছে?

ইউক্যারিওট মানে প্রকৃতকোষীদের কোষে মাইটোকন্ড্রিয়ন (বহুবচনে মাইটোকন্ড্রিয়া) থাকে। এই কোষীয় অঙ্গাণুটা কিন্তু একটা জীবাণু। আগে এটা প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় ছিল, পরবর্তীতে বিবর্তনের ধারায় এটি এন্ডোসিমবায়োসিসের মাধ্যমে প্রকৃ্তকোষীদের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং কোষের মধ্যে মিথোজীবীতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। একইভাবে প্লাস্টিডও (ক্লোরোপ্লাস্ট) উদ্ভিদে ঢোকে। এখন এরা কোষের মধ্যে অন্তঃকোষীয় মিথোজীবী হিসেবে বাস করছে।

বর্তমানে জীববিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, আলফা-প্রোটিওব্যাকটেরিয়া থেকে মাইটোকন্ড্রিয়া এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া থেকে ক্লোরোপ্লাস্টের উদ্ভব। এরা স্বপ্রজননশীল এবং বিপাকে সক্ষম। তাই আমরা একে জীবাণু বলতেই পারি।

শেষ কথা

এতক্ষণের নতুন-পুরাতন কথা পড়ে কী বুঝলেন? এতদিন ধরে জীববিজ্ঞানের যা জানতেন, সেগুলোকে ভুল মনে হচ্ছে? আসলে সবটাকে ভুল বলা যায় না। মূল ব্যাপার হলো, জীববিজ্ঞানের অনেককিছুই দিনকে দিন আপডেট হচ্ছে, আমরা আসলে সেই আপডেটেড তথ্য থেকেই পিছিয়ে আছি। আমরা জীববিজ্ঞানকে যেভাবে ভাবি, বর্তমানের জীববিজ্ঞান মোটেও অমন না।

আজকের ব্লগপোস্ট থেকে নিশ্চয়ই নতুন কিছু জানলেন, নাকি? যদি জেনে থাকেন, তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু!

রেফারেন্স

১. Plasmodium
২. Single-stranded DNA
৩. DNA Triple Helices
৪. Tetraplex DNA and its interacting proteins
৫. What Does the Appendix Do
৬. What Does the Appendix Do? By Randall Gerber
৭. 2-Aminopurine | C5H5N5 | CID 9955 – PubChem
৮. 2-Aminopurine-Science Direct
৯. Wobble base pair – Wikipedia
১০. The tubarial salivary glands: A potential new organ at risk for radiotherapy
১১. Symbiogenesis of mitochondria and plastids
১২. Why Chloroplasts and Mitochondria Contain Genomes

লেখাটি 155-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. Bazlur Rahim Avatar
    Bazlur Rahim

    রেফারেন্সে যা দেয়া হচ্ছে তাতে বই বা প্রবন্ধ প্রকাশের তারিখ, বছর, প্রকাশকের নাম থাকা উচিত। যেন আগ্রহীরা সে- বই দরকার হলে পড়তে পারেন।

    1. তাহসিন আলম উৎস Avatar
      তাহসিন আলম উৎস

      তথ্যসূত্র কোনো বই থেকে নয়, বরং ওয়েব আর্টিকেল থেকে পাওয়া, সেগুলোরই সরাসরি লিংক যুক্ত করা হয়েছে। ধন্যবাদ।

  2. Fariha Afreen Avatar
    Fariha Afreen

    অনেক কিছু জানতে পারলাম 💙
    এগিয়ে যাও..

    1. তাহসিন আলম উৎস Avatar
      তাহসিন আলম উৎস

      😀😃

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading