জিএম শস্য: শঙ্কা ও সচেতনতা


লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

এই লেখাটিকে ‘জিএম শস্য: কী, কেন, কীভাবে‘ শীর্ষক লেখার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। জিএম শস্য তৈরির বৈজ্ঞানিক কৃৎকৌশল ছাড়াও এটি নিয়ে সারা দুনিয়ায় যে জমজমাট বিতর্ক চলছে, তার কিছু ইশারা ওই লেখার শেষে দেওয়া হয়েছিলো। এই লেখায় তার কিছু দিক তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।

দুনিয়ার ইতিহাসের কোন মুহূর্তে জিএম ফসল ঠিক জরুরি হয়ে উঠলো,তার প্রেক্ষাপটটা জানা দরকার। ইংরেজ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস উনিশ শতকের প্রথমভাগে তার জনসংখ্যা তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তার তত্ত্বের সহজ প্রচলিত রূপটি এমন: খাদ্যশস্যের উৎপাদন সমান্তর প্রগমনে বৃদ্ধি পায় কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় গুণোত্তর প্রগমনে। এই অবশ্যম্ভাবী খাদ্য সংকট মোকাবেলায় চিন্তাশীল মানুষ বহুকাল বুদ্ধি নিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তেমনি এক পর্ব কৃষিবিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর নাম ‘সবুজ বিপ্লব’। এ হলো উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, পানি সেচ ও উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষিতে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল।
সবুজ বিপ্ল­বের সূচনা হয় ১৯৪৪ সালে, মেক্সিকোয়, মূলত উচ্চ ফলনশীল গম জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে। খাদ্যশস্যে আমদানিনির্ভর একটি অর্থনীতি থেকে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খুব দ্রুতই দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সাথে সাথে রপ্তানি করতেও শুরু করে। ধীরে ধীরে লাতিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে, এমনকি এশিয়ায় পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশ এই পদ্ধতিতে দ্রুত গতিতে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।

নরম্যান বোরলগ: সবুজ বিপ্লবের পুরোধা বিজ্ঞানী; ছবিসুত্র: Britannica.com

সবুজ বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই প্রথম কৃষি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হলো। একে বলা হলো কৃষিশিল্প (Industrial Agriculture)। কৃষক এর পূর্বে স্থানীয় জাতের বীজ দিয়ে স্থানীয় পরিবেশ ও মৌসুম সম্বন্ধে তার লোকায়ত জ্ঞানের আলোকে কৃষি কাজ করতেন। এই সময় থেকে সার, কীটনাশক,আগাছানাশক বিক্রি করতে বাণিজ্যিক সংস্থার অনুপ্রবেশ ঘটলো এই প্রক্রিয়ায়। কৃষি উৎপাদনের সূচকীয় বৃদ্ধিকে অস্বীকারের জো নেই। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠটাও মানুষের নজর এড়ালো না। কীটনাশক, আগাছা নাশকের প্রভাব পড়লো প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের ওপর। পরিবেশ দূষণ নিয়ে হাহাকার উঠলো বিশ্বজুড়ে। যে ‘বিষ’ পোকা মারতে ব্যবহৃত হচ্ছিলো,তা-ই ঢুকে পড়লো মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য শিকলে। সবুজ বিপ্লবের এই পরিবেশ-বিধ্বংসী দিক আর সমসাময়িক আণবিক জীববিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির সমাপতনে মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এলো জিএম শস্য। এর নানারকম কৌশল পূর্ববর্তী লেখা থেকে পাঠক অবগত আছেন।

জিএম শস্য ভালো নয়, এর মধ্যে দিয়ে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া কিংবা মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের শরীরে, এটা খেলে ক্যানসার হবে এমন নানা কথা আকাশে-বাতাসে ছড়ানো। এই আশঙ্কার সবগুলো বৈজ্ঞানিক নয়। এর বেশিরভাগ অভিযোগ অজ্ঞানতাপ্রসূত, কিছু অভিযোগ প্রাচীন পন্থার প্রতি অতিবিশ্বাসের ফসল (এবং অবশ্যই কিছু অভিযোগ গুরুত্বপূর্ণ!)। জিএম শস্যের ভালো-মন্দ বিচার করতে গিয়ে আমরা প্রায়শই ‘প্রাকৃতিক’ আর ‘নিরাপদ’ এই দুটো শব্দকে গুলিয়ে ফেলি। আগের লেখায় আমরা দেখেছি সনাতন পদ্ধতির ‘কৃত্রিম নির্বাচন’ আসলে সুবিধাজনক জিনের উপস্থিতি নিশ্চিত করারই এক পন্থা। ‌

জিএম ফসল নিয়ে মোটাদাগে কয়েক রকম যৌক্তিক উদ্বেগের জায়গা শনাক্ত করা যায়। সেগুলো এরকম:

প্রথমত, জিনগত পরিবর্তনটি কি উদ্ভিদের নিজের জন্য সুবিধাজনক হবে? উপকারী না হোক, স্বাভাবিক সতেজতা কমিয়ে দেবে কী?

দ্বিতীয়ত, বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এই নতুন ফসলের প্রভাব কী হবে? ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় বা পেস্টকে দমন করতে গিয়ে কি পরাগায়নে-সাহায্যকারী পতঙ্গকেও মেরে ফেলবে এই ফসল? জিএম ফসলের সাথে যদি কাছাকাছি-চাষ-করা অন্য ফসলের পর-পরাগায়ন ঘটে,তাহলে তার ফলাফল কী হবে? মার্কার হিসেবে ব্যবহার করা এন্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জিন কি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াতে ছড়িয়ে পড়তে পারে?

তৃতীয়ত, এই ফসল কী মানুষ খেতে পারবে? বা পশুখাদ্য হিসেবে এর কোনো অংশ ব্যবহার করা যাবে? না কি স্বাস্থ্যহানি ঘটবে?

আগের লেখায় জিএম শস্যের ব্যবহারের যে উদাহরণ দেওয়া হয়েছিলো, সেগুলোর আবিষ্কারের সময়েও এই প্রশ্নগুলোই ঘুরেফিরে উঠেছিলো।

ফসলে ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস এর বিষাক্ত প্রোটিন-উৎপাদনকারী ক্রিস্টাল জিন (Cry জিন) স্থানান্তর জিন প্রকৌশলের অন্যতম সাফল্যের গল্প। আবার এই ঘটনাই জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের। প্রথম আপত্তিটা উঠলো ক্রিস্টাল প্রোটিন মানুষের জন্যেও ক্ষতিকর কিনা। আদতে এই ক্রিস্টাল প্রোটিন কাজ করার জন্য ক্ষারীয় পরিবেশের প্রয়োজন হয়। পতঙ্গের জন্য এই শর্ত ঠিক আছে। কিন্তু মানুষের পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত গ্যাস্ট্রিক রস যে অম্লীয় পরিবেশ তৈরি করে,তাতে এই প্রোটিন কার্যকর হবে না। আবার পতঙ্গের অন্ত্রে এই প্রোটিনের যুক্ত হওয়ার জন্য একদম নির্দিষ্ট গ্রাহক কোষ থাকে,যা মানুষের নেই। ফলে মানুষের জন্য এই ফসল ক্ষতিকর হবে না।

দ্বিতীয় আপত্তিটা উঠলো জীববৈচিত্র্য নিয়ে। ১৯৯৯ সালে একদল বিজ্ঞানী ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে জানালেন বিটি ফসলের পরাগরেণু এক বিশেষ ধরনের প্রজাপতির ক্ষতি করতে পারে। যে প্রোটিন ফসলের পোকামাকড়কে মারতে পারে,তা যে প্রজাপতির মতো পতঙ্গকেও আক্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে এ খবর বিজ্ঞানীরা আগেই অনুমান করেছিলেন। কিন্তু এই গবেষণা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকে ক্ষুব্ধ করে তুললো। জনমনেও জিএম ফসলের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে শঙ্কা তৈরি করলো।

মজার ব্যাপার, গবেষকরা যখন ওই একই পরীক্ষণ ল্যাবরেটরি থেকে বের হয়ে ফসলের মাঠে করলেন, তাদের অনেক আশঙ্কাই অমূলক প্রমাণিত হলো। দেখা গেলো যে পরিমাণ পরাগের সংস্পর্শে এলে প্রজাপতির ক্ষতি হতে পারে,তাতে খুব সামান্য প্রজাপতিই আক্রান্ত হবে। দীর্ঘ দুই বছরের নিবিষ্ট গবেষণার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি গবেষণা সংস্থা ২০০২ সালে ঘোষণা করলো বিটি ফসল ফলালে জীববৈচিত্র্যের ওপর সামান্যই প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশে বিটি বেগুনের চাষ হচ্ছে। ছবিসুত্র: https://www.isaaa.org/default.asp

বাংলাদেশে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে জিনগতভাবে রূপান্তরিত (জিএম) বিটি বেগুন চাষের অনুমোদন দেওয়া হয়, যা ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধে সক্ষম। কাছাকাছি সময়ে গবেষণা শুরু হলেও বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন ও প্রতিবাদের মুখে ভারত ও ফিলিপাইনের সরকার বিটি বেগুন চাষাবাদের জন্যে উন্মুক্ত করতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশে আকস্মিকভাবে সরকারি প্রণোদনায় এর চাষাবাদ শুরু করাকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন অনেক পরিবেশবাদী সংগঠন। আদতেই যথাযথ পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর, আইনকানুন মেনে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের সার্বিক ক্ষতি বিবেচনা করে কৃষকদের কাছে বিটি বেগুনের চারা হস্তান্তর করা হলো কী না এরকম প্রশ্ন ওঠে। যদিও পরবর্তীতে এই ফসল চাষে বিভিন্ন এলাকায় সাফল্যের কথাই জানা যায় পত্রপত্রিকা মারফত।

জিন প্রকৌশল-বিরোধীরা প্রশ্ন তোলেন নতুন যে জিন ফসলে আনা হচ্ছে, খাদ্য হিসেবে গ্রহণের পর মানুষের দেহে এসে তা অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। ১৯৯৬ সালে বিলেতের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক এক জার্নালেও (the New England Journal of Medicine) এই দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ মিললো। দক্ষিণ আমেরিকা-অঞ্চলে জন্মে এমন এক বাদাম (Brazil nut) থেকে পাওয়া একটি জিন সয়াবিনে স্থানান্তর করা হয়েছিল। গবেষকরা দেখলেন আসলেই সেই জিন কিছু মানুষের দেহে অ্যালার্জি তৈরি করতে পারে। এই গবেষণার ফলস্বরূপ ওই বিশেষ জাতের ট্রান্সজেনিক সয়াবিন বাজারে আসতে পারে নি।

এই ঘটনাকে দুইভাবে দেখা যেতে পারে। বিরোধীরা বলবেন এই ঘটনায় খুব পরিষ্কার জিন প্রকৌশলের মধ্যে থেকেই ক্ষতিকর ফলাফল আসতে পারে। নতুন জিন থেকে তৈরি হওয়া নতুন প্রোটিন আরো কত অসচেতন ভোক্তাকে যে আক্রান্ত করতে পারে,তার সুরক্ষা কে দেবে? আবার, জিন প্রকৌশলের পক্ষের লোকেরা বলবেন ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে মানছি, কিন্তু যথাযোগ্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় যথাসময়ে তাকে শনাক্ত করে বাজারে প্রবেশ আটকানো গেছে বৈকি! এই পর্যন্ত বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ অবশ্য মনে করেন জিএম ফসলের মাধ্যমে বড় পরিসরে অ্যালার্জির প্রকোপ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা তেমন একটা নেই।

ফসলি জমিতে যে আগাছা জন্মে,তা মূল ফসলের পুষ্টিতে ভাগ বসায়। এজন্য কৃষক প্রথাগতভাবে জমিতে আগাছানাশক ব্যবহার করেন। এরকম একটি আগাছানাশক হলো রাউন্ডআপ,যার মূল রাসায়নিক পদার্থটির নাম গ্লাইফসেট। এই গ্লাইফসেট আগাছা রোধে দারুণ কার্যকর। গ্লাইফসেট মূলত ইপিএসপিএস (EPSPS) বলে একটি বিশেষ এনজাইমকে আটকে দেয়। এই এনজাইমের অভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য জরুরি অ্যামিনো অ্যাসিডসহ বহু জৈবরাসায়নিকের শারীরবৃত্তীয় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর সমস্যা হলো এটি আগাছার সাথে ফসল উদ্ভিদকেও আক্রান্ত করে ফেলছে। এজন্য হয় কৃষককে ফসল লাগানোর আগেই আগাছানাশক দিতে হয়,অথবা পুনরায় আগাছা জন্মালে খুব সাবধানে ব্যবহার করতে হয়।

কতোগুলো ব্যাকটেরিয়া এমন এনজাইম তৈরি করে,যা গ্লাইফসেট ভাঙতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই জিন শনাক্ত করে ট্রান্সজেনেসিসের মাধ্যমে তুলা ও সয়াবিন উদ্ভিদে স্থানান্তর করে ট্রান্সজেনিক তুলা ও ট্রান্সজেনিক সয়াবিন তৈরি করতে পেরেছেন। এসব ফসলের জমিতে নিশ্চিন্তে গ্লাইফসেট ব্যবহার করা চলে। এতে শুধু আগাছাই মরবে।

১৯৯৬ সাল থেকে মার্কিন দেশে ট্রান্সজেনিক গ্লাইফসেট-প্রতিরোধী ফসলের ব্যবহার এতো বেড়ে যায় যে আগাছানাশক হিসেবে কেবল গ্লাইফসেটের বাজার রমরমা হয়ে উঠলো। আগাছা দমনের বাকি যে-সব পদ্ধতি কৃষক এতদিন তার অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যবহার করে আসছিলেন সেগুলো বাণিজ্যিক সংস্থার মুনাফার তোড়ে হারিয়ে গেলো। কৃষক মাঠে বেশি বেশি গ্লাইফসেট প্রয়োগ করতে লাগলেন। কিন্তু এই আগাছানাশক টি পরিবেশ বা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। মাটি-পানি দূষণ করে এই রাসায়নিক আমাদের খাদ্য শিকলে প্রবেশ করতে পারে। নমুনা প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করে এর বিষাক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মানুষের ক্ষেত্রেও এটি কার্সিনোজেনিক (ক্যান্সার তৈরি করতে সক্ষম) কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একে ‘সম্ভাব্য কার্সিনোজেনিক’ বলে নথিভুক্ত করেছে। আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এই আগাছানাশক ব্যবহার করে স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হয়েছেন,এমন বহু মানুষ মনসান্টোর (রাউন্ডআপ আগাছানাশক এবং আগাছানাশকরোধী বীজ বিক্রি-কারী প্রতিষ্ঠান) বিরুদ্ধে আইনি লড়াইতে অবতীর্ণ হয়েছেন। বেশ কয়েক জায়গায় মনসান্টোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক তথ্য বিকৃতি, নিজস্ব অর্থায়নে ভুয়া গবেষণা, ভোক্তাকে অনবহিত রেখে পণ্য বাজারজাত করার অভিযোগ তোলা হয় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সয়াবিনের সিংহভাগই গ্লাইফসেট-ভিত্তিক আগাছানাশক রাউন্ডআপ-রোধী
ছবিসুত্র- Let’s recognize Roundup Ready and Bt crops as major contributions to sustainable farming – Genetic Literacy Project

দুর্ভাগ্যবশত, যে-সব এলাকায় গ্লাইফসেট-রোধী ফসল দাপটের সাথে চাষ হচ্ছিলো,সেখান থেকেই একসময় বিকশিত হলো গ্লাইফসেট-রোধী আগাছা। ইপিএসপিএস (EPSPS) এনজাইমের এক বিশেষ মিউটেশন শাপেবর হয়ে উঠলো আগাছার জন্য, জন্ম নিলো আগাছানাশক-রোধী ‘সুপার উইড’। আমেরিকা, আর্জেন্টিনা,ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে এরকম আগাছার নমুনা পাওয়া গেলো। এই সমস্যা সমাধানে এখনো কোনো ভালো উপায় পাওয়া যায় নি।

জিন প্রকৌশল অপুষ্টি রোধেও এক নতুন সম্ভাবনা সামনে এনেছিলো। তার নাম গোল্ডেন রাইস বা সুপার রাইস। এই বিশেষ ধানকে জিনগতভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে যাতে করে এই ধানের ভাত খেলে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন তৈরি হয়। বিটা ক্যারোটিন হলো একরকম আদি-ভিটামিন (Pro-vitamin),যা দেহের জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ার ভিটামিন এ’তে পরিণত হয় এবং শোষিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে ভিটামিন এ-এর অভাবে হাজার হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায়। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যকর্মীরা গ্রামে-গ্রামে মহল্লায়-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাইয়ে থাকেন। ভাত প্রিয় জনগোষ্ঠীকে এই আবিষ্কার অন্ধত্বের পাশাপাশি আয়রনের অভাবজনিত সমস্যা থেকেও বাঁচাতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় অবশ্য দেখা গেলো দেহের ব্যবহার্য রূপে আসতে ক্যারোটিনকে অবশ্যই চর্বিতে দ্রবীভূত হতে হবে। অর্থাৎ যে-সব শিশুর খাদ্য তালিকায় যথেষ্ট স্নেহজাতীয় খাদ্য নেই, তারা এই ধানের পূর্ণাঙ্গ সুফল ভোগ করতে পারবে না। আবিষ্কারের দুই বছরের মাথাতেই মাঠপর্যায়ে চাষের জন্য গোল্ডেন রাইস প্রস্তুত ছিল, কিন্তু ২০১১ সাল পর্যন্ত কোথাওই এর তেমন চাষ হয় নি।

এতক্ষণ যে সমস্যা গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো তা মূলত বৈজ্ঞানিক ও কৌশলগত সমস্যা। জিএম শস্য নিয়ে শঙ্কার একটি অর্থনৈতিক দিক আছে। নয়া-উদারবাদী জমানায় বহুজাতিক কর্পোরেশনের ক্ষমতা বহুগুণে বেড়েছে। তারা দুর্বল,নতজানু রাষ্ট্রের ওপর চাপ দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে বিভিন্ন দাতা সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠনের সহায়তায়। বিরোধীরা বলেন জিএম শস্যের বাড়বাড়ন্ত খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদা ও তার যোগানের পথ কৃষির ওপর সিনজেন্টা, মনসান্টো প্রভৃতি মুনাফালোভী বাণিজ্যিক কর্পোরেশনের প্রভাব শক্তিশালী করবে। বর্তমানে আমেরিকার বাজারে প্রায় ৯০ শতাংশ সয়াবিন, তুলা ও ভুট্টার যোগানদাতা মনসান্টো। মনসান্টোর একহাতে আগাছানাশক-রোধী ফসল এবং আরেক হাতে আগাছানাশক বিক্রির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এই আগাছানাশক-রোধী বীজ প্রচলিত বীজের তুলনায় বেশ দামি। বলা হয়ে থাকে, বীজের সাথে কৃষকের সম্পর্ক সন্তানের মতো। মনসান্টো যখন আগাছানাশক সয়াবিন তৈরি করলো,সাথে সাথে সে গোয়েন্দা লেলিয়ে দিলো এটা জানতে যে কোনো কৃষক ফসলের মাঠ থেকে পরের মৌসুমের জন্য বীজ সংগ্রহ করে রাখছেন কী না। বীজ সংগ্রহের এই চর্চা কিন্তু কৃষকেরা বহু যুগ ধরেই করছেন। এতে করে তার খরচও অনেকটা কমে যায়। কিন্তু মনসান্টো এই বীজ পেটেন্ট করে এ-পর্যন্ত বহু কৃষককে বীজ রাখার জন্য আদালতে টেনে নিয়ে গেছে। কৃষকের বীজ রক্ষার অধিকার নিয়ে বহু দেশে বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। বিদেশি জিএম বীজের উপর কৃষকদের পুরোপুরি নির্ভরশীলতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বীজের ওপর বহুজাতিক কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু গ্রহণযোগ্য? ছবিসুত্র- After the March Against Monsanto—What’s Next? – Organic Consumers

মনসান্টো এবং তার মতো অন্যান্য কর্পোরেশনের অস্বচ্ছতা, অনৈতিক বাণিজ্যচর্চার ব্যাপারে অবশ্যই আমাদের সচেতন হতে হবে। অবশ্যই আমাদের যাচাই করে দেখতে হবে জিনগত পরিবর্তনের ফল শুধু উৎপাদন ব্যবস্থাতেই নয়, পরিবেশে এবং স্থানীয় সমাজ-অর্থনীতি ও প্রাণবৈচিত্র্যে এর প্রভাব কীরকম হবে। কিন্তু তার জন্য জিএম ফসলকে ঢালাও সমালোচনা করা,বাতিল করে দেওয়াটা হবে নিদারুণ বোকামি। এটা অনেকটা ইন্টারনেটকে খারাপ বলে তার থেকে দূরে থাকার মতো। অবশ্যই এর মন্দ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, রয়েছে বাণিজ্যিক দুরভিসন্ধির আশঙ্কা। কিন্তু যে-অসামান্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে জিএম শস্যের আবিষ্কারে, তাকে বাতিল করে দিলে আমরাই পিছিয়ে পড়বো। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অগ্রগতি,বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আমাদের আর পেছনে সনাতন পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আয়ারল্যান্ড জিএম শস্যের চাষবাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কারণ হিসেবে তারা পরিবেশ বিপর্যয়, সবুজ-সাশ্রয়ী-টেকসই কৃষিকে অগ্রাধিকার ইত্যাদি যুক্তি সামনে এনেছে। বাস্তবতা হচ্ছে আয়ারল্যান্ড তার বর্তমান অবকাঠামো, পরিবেশ-বিষয়ক নীতি,চর্চা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সূচকে পরিবেশ বিপর্যয়ের দিক দিয়ে দ্বিতীয় সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে। জিএম শস্যের সুনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগই বরং পরিবেশ-রক্ষায় দেশটিকে সহায়তা করতে পারতো। জিএম প্রযুক্তি কীভাবে হাওয়াই’তে পেঁপে’র পুনর্জন্ম দিয়েছিলো,সে-কথা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে দেশটিতে রিংস্পট ভাইরাসের প্রকোপে পেঁপের চাষ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো। এই সমস্যা মোকাবেলায় কৃষিবিজ্ঞানীরা ‘রেইনবো’ নামে পেঁপের এক নতুন জাত তৈরি করলেন। এই পেঁপেতে নিজে থেকেই ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরি হয়। কৃষকেরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, স্থানীয় অর্থনীতিও চাঙ্গা হলো।

জিএম খাদ্যকে আলাদা করতে লেবেল সেঁটে দেওয়া হয়েছে। ছবিসুত্র- How Your Food Gets The ‘Non-GMO’ Label : The Salt : NPR

বিজ্ঞানব্লগে প্রকাশিত বিটি-বেগুন সংক্রান্ত একটি লেখায় সৌমিত্র চক্রবর্তীর একটি মন্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য:

“এক প্রজাতির জীবের জিনোমে আরেক প্রজাতির জিনোম প্রবেশ করালে তার ফল কী হতে পারে তা নিখুঁতভাবে নির্ণয় করার মতো বিজ্ঞান এখনো আমাদের হাতে আসেনি। জিনোম কোনো Object Oriented Programming (OOP) জাতীয় কোডের মতো নয় যে এর বিভিন্ন অংশ encapsulated; অর্থাৎ এক অংশে কোনো নতুন কোড ঢোকালে আরেক অংশের কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়বে না। তাই genetically engineered যেকোনো পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে যেকোনো ওষুধের মতোই তার তিন/চার ধাপের clinical trial হতে হবে।”

আদতেই খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে এমন কোনো জিএম পণ্য বাজারে আনার আগে বিজ্ঞানীদের ল্যাবরেটরিতে নমুনা প্রাণীর ওপর (যেমন ইঁদুর বা হ্যামস্টার) পরীক্ষা করে দেখতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কালচার করা মানবকোষের ওপরেও পরীক্ষা করা হয়। প্রায় কয়েক মাস এরকম পরীক্ষা করে খাদ্যপণ্যটির বিষাক্ততা পরীক্ষা করা হয়। অত্যন্ত নিখুঁত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কোনোমতেই একে বাজারে ছাড়ার উপায় নাই।

ছবি- কার্টাগেনা প্রটোকল

জেনেটিক প্রযুক্তি ব্যবহারের আন্তর্জাতিক সনদ কার্টাগেনা প্রটোকলে অনেক সতর্কতার বিধান রাখা হয়েছে। এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো জিএমও ব্যবহার,স্থানান্তর,ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কতকগুলো বিশেষ নিয়মনীতি মানতে দায়বদ্ধ। এর অন্যতম একটি বিধান হচ্ছে কোনো ফসলের আদি উৎপত্তি স্থলে জিএম ফসল প্রবর্তন করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ এতে স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য ও বাজার নষ্ট হতে পারে। এই কথা আরো সত্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো জন্য। বাংলাদেশ কৃষি বৈচিত্র্যে, ভূসম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি দেশ। পরিবর্তিত বিশ্ব-পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত হবে নিজ নিজ দেশে উপযোগী জাত উৎপাদনে জীবপ্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়ন। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।‌ সেগুলো যেন দেশের জল-মাটি-হাওয়া এবং তার মানুষের স্বার্থ বিবেচনায় রেখে জিএম ফসল সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়,এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। ব্রাজিল ও চীন নিজ নিজ দেশে জিএম প্রযুক্তিতে বীজ তৈরি করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে,বাইরের কোনো বহুজাতিক কর্পোরেশনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই। এদের অভিজ্ঞতা সামনের দিনগুলোতে আমাদের পাথেয় হতে পারে।

মোটকথা, মানুষের জীবনমান উন্নয়নে জিএম প্রযুক্তি সহায়ক হতে পারে। তবে এই প্রযুক্তির অপব্যবহার যেন না হয়, তার জন্য নিবিড় মূল্যায়ন, পরীক্ষণ ও সাবধানতা জরুরি।

তথ্যসূত্র:

বই-

  • Introduction to Biotechnology (Third Edition) by William J. Thieman and Michael A. Palladino

লেখাটি 115-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading