মোশন সিকনেস (Motion Sickness) বা গতি-অসুস্থতা আমাদের পরিচিত কিছু মানুষদের-ই দারুণ ভীতির কারণ। ভীতি কেন বলছি? কারণ এই একটি সমস্যার জন্যই আমাদের অনেক প্রিয় বন্ধুরা আমাদের সাথে দূরদূরান্তে ট্যুর তথা ভ্রমণে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। করবে-ই বা কেন? দূরে যেতে হলে তো দরকার গাড়ির। আর এই ‘গাড়ি’-ই তো সব সমস্যার গোড়া। তাই নয় কি? গাড়িতে ওঠে চলা শুরুর পর থেকে শরীরে এক বিচ্ছিরি অনুভূতি হওয়া এবং পরিশেষে জাফর ইকবাল স্যারের ভাষায় “গা গুলিয়ে হরহর করে বমি করে দেওয়া”র মাধ্যমে এই অসুস্থতার শেষ হওয়াই মোশন সিকনেস।
মোশন সিকনেস কতোটা বাজে হতে পারে তা কেবল একজন ভ্রমণপিয়াসী-ই বলতে পারবেন। তারা কোথাও ঘুরতে গিয়ে আনন্দ করতে পারেন না। কেননা গাড়ি থেকে নেমে গেলেও দেখা যাচ্ছে শরীর গুলিয়ে ওঠার প্রভাবটা দীর্ঘক্ষণ থেকে যায় এবং কিছুক্ষণ পরপর মাথা ঘুরাতে থাকে, শরীর দূর্বল লাগে। অনেকে টানা দুইদিনও গাড়ির রেশ কাটাতে পারেন না এবং প্রতিটা মিনিটে বেশ কষ্ট পান। আজকের লেখাটি তাই সেসব ভুক্তভোগীদের জন্য। এই মোশন সিকনেস দূর করার কি আদৌও কোনো উপায় আছে?
জি, অন্যান্য সকল সমস্যার মতো এই সমস্যারও প্রতিরোধ করার উপায় আছে। তবে কোনো সমস্যা দূর করার জন্য শিকড়ের আগা না কেটে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই আগে চলুন জেনে নেই মোশন সিকনেসটা ঠিক কেন হয়।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/01/image-14.png?resize=600%2C294&ssl=1)
মোশন সিকনেসের কারণ
মোশন সিকনেস এর পেছনে আসলে পদার্থবিজ্ঞানের গতি তো বটেই, সাথে সাথে আমাদের দেহের জীববিজ্ঞানও জড়িত। একটু সহজ করে বলি-
আমাদের মস্তিষ্ক বিভিন্ন স্তন্যপায়ীদের মধ্যে বেশ উন্নত। এই মস্তিষ্ক আমাদের দেহের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। আমাদের শরীরের সুস্থতা নিয়ে সবচাইতে বেশি সচেতন থাকে আমাদের এই খুলির ভেতর সুরক্ষিত থাকা মস্তিষ্ক। তো মোশন সিকনেসটাও মস্তিষ্কের এক ধরণের সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ।
অসুস্থতা কীভাবে সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ হয় বিষয়টা বেমানান লাগলেও এটাই সত্যি। আমাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দীর্ঘ দেহটার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আমাদের দেহের অন্ত:কর্ণ সর্বদা দায়িত্বরত। আমরা সকল ধরণের গতি, বেগ, স্থিতি ইত্যাদি অনুভব করতে পারি এবং সকল ধরণের গতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারি কেবল অন্ত:কর্ণের অবদানের কারণে। যখন আমরা গাড়িতে চড়ি এবং গাড়ি চলতে থাকে তখন আমাদের অন্ত:কর্ণ দেহের হেড অফিস তথা মস্তিষ্ককে সিগন্যাল পাঠায় “আমরা এখন চলছি, আমরা এখন গতিশীল”। কেননা সে গতিকে ঠিকঠাক ভাবেই অনুভব করতে পারছে।
তবে বিপত্তিটা ঘটায় আমাদের অন্যতম প্রধান ইন্দ্রিয় চোখ। গাড়িতে থাকা ব্যাক্তি নিজের সাপেক্ষে গাড়ির ভেতরের সকল কিছুকেই স্থির দেখেন। কেননা তিনি যেমন গাড়ির ভেতর গতিশীল অবস্থায় আছেন, ঠিক তেমনই গাড়ির চালক, কিংবা পাশে বসে থাকা পরিচিত ব্যাক্তিও ঠিক তার মতো গতিশীল অবস্থায় আছেন। গতিশীল ব্যাক্তি নিজের সাপেক্ষে অন্য গতিশীল ব্যাক্তি বা বস্তুকে স্থির দেখেন। ফলে তার দৃষ্টিশক্তি মস্তিককে জানান দেয় “আমরা তো এক জায়গায় স্থির আছি।”
ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে কি? একই দেহ, একই শরীরের দুটি ইন্দ্রিয়, একই সময়ে, একই মস্তিষ্ককে দু’রকম তথ্য দিচ্ছে! আজব না? অন্তঃকর্ণ বলছে আমরা গতিশীল অথচ চোখ বলছে আমরা স্থির! এখানেই মূলত আমাদের মস্তিষ্ক ঘাবড়ে যায়। দেহের দু’জায়গা থেকে দু’রকম তথ্য পেয়ে মস্তিষ্ক হিসাব মেলাতে পারে না এবং ধরে নেয় দেহে বিষক্রিয়া হয়েছে। এখন যে করেই হোক এই বিষক্রিয়া থামাতে হবে, দেহকে বিষমুক্ত করতে হবে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় কীভাবে করবে? সাধারণত খাবারের মাধ্যমেই আমাদের শরীরে বিষ প্রবেশ করে থাকে। তাই পাকস্থলীতে উপস্থিত সকল খাবার, তা হোক আধা পরিপাক কিংবা অপরিপাক, সম্পূর্ণটাই উগলে দিতে চেষ্টা করে মস্তিষ্ক। দেহকে বিষক্রিয়া থেকে বাঁচানোর জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে আমাদের ব্রেইন এরকম বমির উদ্রেক ঘটিয়ে থাকে।
অনেকের গাড়িতে খারাপ লাগে, তবে ঠিক বমি হয় না। এই খারাপ লাগা বা মাথা ঘোরানোর কারণটাও দুই ইন্দ্রিয় ঘটিত। গাড়ি, প্লেন, বাস, টেন যেকোনো বাহনে যে কারও সাথে এই ঘটনা ঘটতে পারে। সমুদ্র ভ্রমণ বা জাহাজে এমন অসুস্থতা হলে তাকে “সি সিকনেস” বলে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/01/image-15.png?resize=1024%2C682&ssl=1)
মোশন সিকনেস নিরাময় যোগ্য?
অবশ্যই। এটা মানব মস্তিষ্কের ভুল ধারণা ছাড়া আর কিছুই না। সুতরাং মস্তিষ্ককে সঠিক ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেই মোশন সিকনেস নিজ থেকে কেটে যাবে। আপনি গাড়িতে থাকলে স্বভাবতই আপনার অন্তঃকর্ণ গতির অনুভূতি প্রদান করবে।
আপনার অন্তঃকর্ণ আপনার নিয়ন্ত্রণের আওতাধীন নয়। কিন্তু আপনি চাইলেই আপনার চোখ এদিক ওদিক ঘোরাতে পারেন। গাড়ি চলার সময় যদি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন তবে দেখবেন ঘরবাড়ি, দোকানপাট, গাছপালা সব পেছন দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। যদিও সেগুলো দৌড়াচ্ছে না। আপনি সামনে চলে যাচ্ছেন। তবুও আপনার সাপেক্ষে সেগুলোকে গতিশীল বলে মনে হবে।
সুতরাং আপনার চোখ এই দৃশ্য দেখার পর আপনার ব্রেইনকে যেই সিগন্যাল দেবে তা অন্তঃকর্ণের দেওয়া সিগন্যালের সাথে খাপে খাপ মিলে যাবে। একই তথ্য গ্রহণ করে ব্রেইন স্বস্তিবোধ করবে এবং আপনার অসুস্থতা বোধ হবে না।
এছাড়াও মোশন সিকনেস কমাতে যা যা করা যেতে পারে
১. ভ্রমণের পূর্বে পেট ভরে কিছু না খাওয়াই ভালো। সম্ভব হলে চা কফি থেকে দূরে থাকতে হবে।
২. চাইলে যাত্রাকালীন সম্পূর্ণ পথ ঘুমিয়ে কাটাতে পারেন।
৩. বই পড়া কিংবা মোবাইল না চালানোই ভালো
৪. গাড়িতে গান ছেড়ে অথবা নিজ মোবাইলে গান ছেড়ে ইয়ারফোন দিয়ে শুনতে থাকুন। এতে করে আপনার মন অনেকটাই ডাইভার্ট হয়।
৫. বাজারে বমিরোধক ওষুধ পাওয়া যায়। চাইলে তা ব্যবহার করে নিতে পারেন।
৬. বেশি বেশি পানি পান করুন। অযথা কথা বলা থেকে দূরে থাকুন।
৭. অতিরিক্ত খারাপ লাগলে জানালা খুলে খোলা বাতাসে ধীরে ধীরে প্রশ্বাস নিন যতক্ষণ না আপনার স্বস্তি বোধ হচ্ছে।
৮. বমির কথা মাথায় আনবেন না।
৯. নিজেকে অভ্যস্ত করতে বেশি বেশি গাড়িতে ওঠা।
পরিশেষে, অনেকেই বলে থাকেন গাড়িতে বমি হওয়া একটা মানসিক সমস্যা। আপনি যতই চিন্তা করবেন ততো-ই সেটা হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। তবে ব্যাপারটা ঠিক তেমন না। নিছক মস্তিষ্ক জনিত ক্রুটি যা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে নিরাময় যোগ্য। উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করলে আপনি খুব কম সময়ের ভেতর মোশন সিকনেস কাটিয়ে উঠতে পারবেন আশা করা যায়।
আজ এ পর্যন্তই। সম্পূর্ন পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র
Leave a Reply