আপনি যদি ইন্টারনেটে ‘দ্রুততম মানব ক্যালকুলেটর’ লিখে অনুসন্ধান করেন, তবে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের নীলকন্ঠ ভানু প্রকাশের নামটি সামনে আসবে, যাকে বিবিসি ‘গণিতের উসাইন বোল্ট’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে [১]। তিনি ২০২০ সালের আগস্টে লন্ডনে আয়োজিত মাইন্ড স্পোর্টস অলিম্পিয়াডের (MSO) মেন্টাল ক্যালকুলেশনস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক অর্জন করেন [২] এবং এসময় তাঁর স্বদেশী ‘মানব কম্পিউটার’ খ্যাত শকুন্তলা দেবীর [৩] রেকর্ড ভাঙেন। বলুন তো তাঁদের এই বিদ্যুৎ গতির গণন ক্ষমতার রহস্য কী? আপনি হয়তো বলবেন যে তাঁরা আবশ্যিকভাবে ঐশ্বরিক প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু তাঁদের এই অসামান্য ক্ষমতার সবটুকুই কি ঈশ্বর প্রদত্ত? এর নেপথ্যে কি কোনো গোপন কৌশল নেই? আছে অবশ্যই, আর আজকের এই আলোচনায় আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি মানসাঙ্কের কিছু চমৎকার কৌশল নিয়ে।
১১ দ্বারা গুণের কৌশল
ধরুন আপনাকে বলা হলো কোনো ক্যালকুলেটর বা খাতা-কলম ব্যবহার না করে ২৭ × ১১ এর ফলাফল বের করতে, তখন আপনি কী করবেন? ‘মনে মনে’ হিসাব করা ছাড়া যে আর কোনো উপায়ান্তর নেই। পারবেন তো? যদি আপনার উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আর যদি আপনি ‘মনে মনে’ এই হিসাবটি করার কৌশল সম্পর্কে অবগত না থাকেন, তবে আপনাকে অনুরোধ করবো একটু ধৈর্য সহকারে এই আর্টিকেলটি পড়ার জন্য।
তো চলুন দেখে নিই ২৭ × ১১ এর ফলাফল কিভাবে ‘মনে মনে’ করা যায়।
এবার একটু সহজে ব্যাখ্যা করে বলি। দুই অঙ্কবিশিষ্ট কোনো সংখ্যাকে (মূল সংখ্যা) ১১ দ্বারা গুণ করলে গুণফলের –
- এককের অঙ্ক হবে মূল সংখ্যার এককের অঙ্ক
- দশকের অঙ্ক হবে মূল সংখ্যার একক ও দশকের অঙ্কের যোগফল
- শতকের অঙ্ক হবে মূল সংখ্যার দশকের অঙ্ক
এবার আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। বলুন তো, ৬৯ (মূল সংখ্যা) কে ১১ দ্বারা গুণ করলে গুণফল কত হবে? চলুন উপরের নিয়ম অনুযায়ী চেষ্টা করে দেখি। এক্ষেত্রে স্পষ্টত, মূল সংখ্যার অঙ্কদ্বয়ের যোগফল ১০ বা তদূর্ধ্ব, অর্থাৎ ৬ + ৯ = ১৫।
সহজভাবে বললে, দুই অঙ্কবিশিষ্ট কোনো সংখ্যাকে (যার অঙ্কদ্বয়ের যোগফল ১০ বা তদূর্ধ্ব) ১১ দ্বারা গুণ করলে গুণফলের –
- এককের অঙ্ক হবে মূল সংখ্যার এককের অঙ্ক
- মূল সংখ্যার অঙ্কদ্বয়ের যোগফল যত, তার এককের অঙ্ক বসবে, দশকের অঙ্ক হাতে থাকবে
- শতকের অঙ্ক হবে মূল সংখ্যার দশকের অঙ্কের সাথে আগের ধাপের হাতে থাকা অঙ্কের যোগফল
এতোক্ষণ তো দুই অঙ্ক বিশিষ্ট কোনো সংখ্যাকে ১১ দিয়ে গুণের নিয়ম সম্পর্কে আলোচনা করলাম। খুবই সহজ, তাই না! এবার আরেক ধাপ অগ্রসর হওয়া যাক। দেখি তো তিন অঙ্কবিশিষ্ট কোনো সংখ্যাকে ১১ দিয়ে গুণের নিয়ম কী? ধরা যাক, তিন অঙ্কবিশিষ্ট মূল সংখ্যাটি হচ্ছে ৭৪৯। একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে, এক্ষেত্রে গুণফল হবে চার অঙ্কবিশিষ্ট।
এখন যদি ধাপগুলোকে সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করতে যাই, তবে এভাবে বলতে হবে যে গুণফলের –
- এককের অঙ্ক হবে মূল সংখ্যার এককের অঙ্ক
- দশকের অঙ্ক হবে মূল সংখ্যার একক ও দশকের অঙ্কের যোগফল, আর তা যদি ১০ বা তদূর্ধ্ব হয় তবে তার এককের অঙ্ক বসবে, দশকের অঙ্ক হাতে থাকবে
- শতকের অঙ্ক হবে মূল সংখ্যার দশক ও শতকের অঙ্কের যোগফল, সাথে আগের হাতে থাকা অঙ্ক যোগ করতে হবে। এ যোগফল যদি ১০ বা তদূর্ধ্ব হয় তবে তার এককের অঙ্ক বসবে, দশকের অঙ্ক হাতে থাকবে
- সহস্রের অঙ্ক হবে মূল সংখ্যার শতকের অঙ্কের সাথে আগের ধাপের হাতে থাকা অঙ্ক (যদি থাকে) যোগ করে যা হয় তা
উপরে বর্ণিত নিয়ম শুধু দুই বা তিন অঙ্কবিশিষ্ট সংখ্যার জন্যই প্রযোজ্য নয়, যে কোনো অঙ্কবিশিষ্ট সংখ্যাকে ১১ দিয়ে গুণের নিয়ম এই পদ্ধতি অনুসরণ করে দ্রুতগতিতে করে ফেলা যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, গুণফলের অঙ্কসংখ্যা হবে মূল সংখ্যার অঙ্কসংখ্যার চেয়ে এক বেশি।
আপনারা চাইলে নিচের ছোট ভিডিওটি এক নজর দেখে নিতে পারেন।
এবার দেখি তো আপনারা কেমন শিখলেন? বলুন তো ২৭ × ৬৬ = ? হ্যাঁ, ঠিক ধরতে পেরেছেন। আমরা সরাসরি ২৭ কে ৬৬ দিয়ে গুণ করতে যাবো না। প্রথমে ২৭ কে ১১ দিয়ে গুণ করে সেই গুণফলকে পরে ৬ দিয়ে গুণ করবো। ব্যস, পেয়ে যাবো প্রত্যাশিত গুণফল। অর্থাৎ গাণিতিকভাবে,
২৭ × ৬৬ | = (২৭ × ১১) × ৬ |
= ২৯৭ × ৬ | |
= ১৭৮২ |
শেষের ধাপ অর্থাৎ ২৯৭ কে ৬ দিয়ে গুণ করার মানে হচ্ছে কোনো সংখ্যাকে এক অঙ্কবিশিষ্ট সংখ্যা দিয়ে গুণ করা, যা ‘মনে মনেই’ করা যায়।
তাহলে যে কোনো সংখ্যাকে ১১ এর গুণিতক তথা ২২, ৩৩, ৪৪, ৫৫, ৬৬, ৭৭, ৮৮ অথবা ৯৯ দিয়ে গুণের নিয়মও আমরা জেনে গেলাম।
৫ একক স্থানীয় অঙ্কবিশিষ্ট সংখ্যার বর্গ
এবার বলুন তো ৭৫ সংখ্যাটির বর্গ করলে কত হয়? খেয়াল করে দেখুন ৭৫ সংখ্যাটির একক স্থানীয় অঙ্ক হচ্ছে ৫। চলুন দেখি কীভাবে বর্গের ফল বের করতে হয়।
অর্থাৎ ৫ অঙ্কটি দ্বারা শেষ হয় এমন সংখ্যার বর্গ করতে হলে প্রথমে ৫ ব্যতীত সামনের বাকি অংশের জন্য ঐ সংখ্যা আর এর পরের সংখ্যার গুণফল লিখতে হবে। এরপর ৫ এর জন্য ২৫ লিখলেই কাঙ্ক্ষিত বর্গফল পাওয়া যাবে। এইভাবে
(৪৫)২ = ২০২৫
(১১৫)২ = ১৩২২৫
নিচের ভিডিওর মাধ্যমে পদ্ধতিটি ভিজুয়ালাইজ করতে পারেন।
এবার এই পদ্ধতিকে একটু সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। দুই অঙ্কবিশিষ্ট দুইটি সংখ্যার গুণফল যাদের প্রথম তথা দশক স্থানীয় অঙ্ক একই এবং যাদের একক স্থানীয় অঙ্কদ্বয়ের যোগফল ১০। উদাহরণস্বরূপ সংখ্যা দুইটি ৬৩ এবং ৬৭ ধরে নিই। এখানে সংখ্যাদ্বয়ের দশক অঙ্ক উভয় ক্ষেত্রেই ৬ এবং একক অঙ্কদ্বয় ৩ ও ৭ এর যোগফল ১০। চলুন তাহলে কৌশলটি রপ্ত করে নিই।
সূত্রের প্রয়োগ করে গুণন
আমাদের নিশ্চয়ই নিচের সূত্রটির কথা মনে আছে।
$$ (a-b)(a+b)=a^2-b^2 $$
চলুন তাহলে এই সূত্র প্রয়োগ করে দুইটি সংখ্যার গুণফল বের করি। তবে এক্ষেত্রে সংখ্যাদ্বয়ের অন্তর জোড় হতে হবে। ধরি সংখ্যা দুইটি ৩৭ ও ৪৩ এবং এদের অন্তর ৬।
৩৭ × ৪৩ | = (৪০ – ৩) × (৪০ + ৩) | ||||
= ৪০২ – ৩২ | |||||
= ১৬০০ – ৯ | |||||
= ১৫৯১ |
এখানে ৩৭ এবং ৪৩ এর মধ্যবর্তী সংখ্যা ৪০ থেকে উভয়ের পার্থক্য হচ্ছে ৩। ৩৭ এর সাথে ৩ যোগ করলে এবং ৪৩ থেকে ৩ বিয়োগ করলে উভয় ক্ষেত্রেই ৪০ পাওয়া যাবে। এবার আরেকটি উদাহরণ খেয়াল করি। আমরা যদি একটি সংখ্যা ১৬ এবং অপর সংখ্যাটি ৭৮ ধরি, তবে এদের বিয়োগফল ৬২, যার অর্ধেক হচ্ছে ৩১। সুতরাং, (১৬ + ৩১) = (৭৮ – ৩১)।
১৬ × ৭৮ | = (৪৭ – ৩১) × (৪৭ + ৩১) | ||||
= ৪৭২ – ৩১২ | |||||
= ২২০৯ – ৯৬১ | |||||
= ১২৪৮ |
লক্ষণীয় যে, এই নিয়মে গুণ করতে গেলে সংখ্যাদ্বয়ের অন্তর কম হলে সুবিধা হয়। নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন।
৫, ২৫ এবং ৫০ দ্বারা ভাগ
আপনি যদি কোনো সংখ্যাকে ৫ দ্বারা ভাগ করতে যান, তবে আমি আপনাকে সরাসরি ভাগের প্রক্রিয়া অবলম্বনে নিরুৎসাহিত করবো। আমি আপনাকে পরামর্শ দিবো সংখ্যাটিকে প্রথমে ২ দ্বারা গুণ করে উক্ত গুণফলকে ১০ দ্বারা ভাগের নিয়মানুযায়ী দশমিক বিন্দু এক ঘর বামে এগিয়ে দিতে।
২৫ দ্বারা ভাগের ক্ষেত্রে উপরের নিয়মেই ২ এর স্থলে ৪ দ্বারা গুণ করে দশমিক বিন্দু দুই ঘর বামে এগিয়ে দিলেই শেষ। ব্যস, পেয়ে যাবেন কাঙ্ক্ষিত ভাগফল।
আর ৫০ দ্বারা ভাগের সময় ৫ এর নিয়মেই ২ দ্বারা গুণ করবেন, কিন্তু এবার মনে রাখবেন দশমিক বিন্দু দুই ঘর বামে এনে দিতে হবে।
নিচের ভিডিওটি আপনাদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
দুই অঙ্কবিশিষ্ট যে কোনো সংখ্যার বর্গ
এ পদ্ধতিতে ১০ থেকে ৯৯ পর্যন্ত যে কোনো সংখ্যার বর্গ নির্ণয় করা যাবে খুব সহজেই। এজন্য যে সংখ্যার বর্গ নির্ণয় করতে হবে, সেটিকে এর কাছাকাছি ভিত্তি সংখ্যার (১০, ২০, ৩০, ৪০, . . .) সাথে তুলনা করতে হবে। চলুন সম্পূর্ণ পদ্ধতিটি জেনে নিই একটি উদাহরণের মাধ্যমে। মনে করি ১৮ এর বর্গ নির্ণয় করতে হবে। আমরা তো নিশ্চয়ই জানি যে, (১৮)২ = ১৮ × ১৮, অর্থাৎ ১৮ এর বর্গ হচ্ছে দুইটি ১৮ এর গুণফল। এখন ১৮ এর কাছাকাছি ভিত্তি সংখ্যা হচ্ছে ২০। আমরা দুইটি ১৮ এর একটির সাথে ২ যোগ করে ২০ বিবেচনা করবো এবং অপরটি থেকে ২ বিয়োগ করে ১৬ বিবেচনা করবো। এরপর ২০ এবং ১৬ গুণ করে গুনফলের সাথে একটু আগে যে সংখ্যাটি যোগ-বিয়োগ করা হলো তার বর্গ (এক্ষেত্রে ২২ = ৪) যোগ করলেই উদ্দিষ্ট বর্গফল পাওয়া যাবে। নিচের ফ্লোচার্টে বিষয়টি তুলে ধরা হলো।
নিচের ধাপগুলো খেয়াল করলেই এর ব্যাখ্যা পেয়ে যাবেন।
অপর একটি উদাহরণের মাধ্যমে এই লেখার সমাপ্তি টানবো। ধরি ৮৪ এর বর্গ নির্ণয় করতে হবে। এক্ষেত্রে ভিত্তি সংখ্যা ৮০ বিবেচনা করবো। অবশ্য আপনি চাইলে ভিত্তি সংখ্যা ৯০ ধরে উক্ত প্রক্রিয়ায় বর্গফল বের করতে পারেন।
যদি উপরের আলোচনা বুঝতে কষ্ট হয়ে থাকে, তবে আপনি এই ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন।
কথা তো কম হলো না। অনেকগুলো কৌশল শিখে নিলাম। আজকে তাহলে এই পর্যন্তই। শেষ বেলায় বোনাস টিপস হিসেবে আপনাদের ২০ পর্যন্ত সংখ্যার বর্গফল এবং ১০ পর্যন্ত সংখ্যার ঘনফল মনে রাখতে পরামর্শ দিবো। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে – অনুশীলন! এর কোনো বিকল্প নেই। সংখ্যার সৌন্দর্য আপনাকে মোহিত করুক – এই প্রত্যাশা করি।
তথ্যসূত্র–
[১] Aged 20 and the fastest human calculator in the world | BBC
[২] Previous Results 2020 – Mind Sports Olympiad
[৩] শকুন্তলা দেবী – উইকিপিডিয়া
[৪] Secrets of Mental Math, Arthur Benjamin & Michael Shermer
Leave a Reply