পনেরো বছর আগের কথা। এক কেজি ইলিশের দাম ছিল প্রায় ৬৫০ টাকা। স্বাদে-গুণে ঐ মাছগুলোর সাথে আজকের দিনের ইলিশের তুলনাই হয় না। মাছগুলো যেমন ছিল তাজা, তেমনি ছিল ওজন! কিন্তু এখন কী খাচ্ছি আমরা? দাম বেড়েছে, কিন্তু স্বাদ গিয়েছে কমে। শুধু তা-ই নয়, মেনি, বেতাঙ্গি, কুইচ্চার মতো বিভিন্ন মাছও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। জানেন, কেন এমন কাহিনী হলো?
মূল কারণ হলো আমরা মাছদের স্বাভাবিক প্রজননে বাজেভাবে বাধা দিচ্ছি। যে স্থানে যে সময়ে কোনো একটি মাছের ব্যাপক বংশবৃদ্ধি ঘটার কথা, আমরা সেই সময় ও স্থান-দুটোকেই নষ্ট করছি। যেভাবে-সেভাবে মাছ শিকার, হ্যাচারিতে অল্প ও নির্দিষ্ট মাছের মধ্যে অন্তঃপ্রজনন, জলাশয়ের পরিবেশ নষ্ট করা ইত্যাদি কারণে একদিকে যেমন প্রজননের অবাধ সুযোগ কমে যাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে কৃত্রিম পরিবেশে সৃষ্ট পোনার গুণাবলিও হ্রাস পাচ্ছে। ফলে মাছগুলোর জিনগত বৈচিত্র্য কমছে, কিন্তু রোগের হার বাড়ছে। এতে করে আমরা প্রায়শই অপুষ্ট মাছ খাচ্ছি।
দেখুন, বাংলাদেশের বড় বড় নদী (যেমন-পদ্মা, হালদা, কর্ণফুলী ইত্যাদি), হ্রদ (যেমন-কাপ্তাই হ্রদ) এবং হাওর (যেমন-টাঙ্গুয়ার হাওর) সহ বিভিন্ন জলাশয় হলো মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র। কিন্তু দিনে দিনে এসব নদী, হাওর, বিল ও হ্রদের পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে উঠছে। এর পেছনে রয়েছে পানি দূষণ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ এবং নদী ভরাট করার মতো প্রকৃতিবিধ্বংসী কাজ, যেগুলো মাছের স্পনিং (ডিম ছাড়া ও শুক্রাণু ত্যাগ) এর মাত্রাকে কমিয়ে দিচ্ছে। আবার পানির গুণগত মান হাস পাওয়ায় সেই পানি রেণু পোনা বা ধানী পোনার সুস্থ বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাছাড়াও প্রয়োজন বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি।
এসিড বৃষ্টিও এই সমস্যায় একটা বড় ফ্যাক্টর। কারণ যদি বড় বড় প্রজননক্ষেত্রের আশেপাশে থাকা কলকারখানার ক্ষতিকর ধোঁয়া বৃষ্টির পানির সাথে মিশে এসিডে পরিণত হয়ে জলাশয়গুলোতে পড়ে, তখন ঐ প্রজননক্ষেত্রগুলোতে এসিডিফিকেশন ঘটতে পারে। ফলস্বরূপ ঐ পানির এসিডিটি বেড়ে যায় মানে পিএইচ মান হ্রাস পায়। আর U.S. Environmental Protection Agency এর মতে, বেশিরভাগ মাছের ডিম ৫ মানের পিএইচ এ ফুটতে পারে না। শুধু তা-ই নয় মাছের স্বাভাবিক বিপাকেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই অম্লীয় বা এসিডিক পানি।
বিবিসি বাংলার ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশে ‘প্রায় বিলুপ্তি’র পথে ১০০-এর বেশি দেশীয় মাছ”। তাহলে এখন সেই সংখ্যাটা কত হতে পারে? যাহোক, অনেকেই হয়ত সমাধান হিসেবে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের কথা বলবেন। কিন্তু হ্যাচারির ব্যাপারটা অনেকটা চিড়িয়াখানায় পশু পালনের মতো! হ্যাচারির মাছের স্বাদ কখনোই সেই শৈশবের মাছের মতো হবে না। শুধু তা-ই নয়, এই মাছগুলো অনেক ক্ষেত্রে সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। আর এমন মাছ খেলে বাজতে পারে শরীরের বারোটা। তাই আমাদের মাছগুলোকে সুস্থভাবে বাঁচতে দিতে চাইলে এবং ভালো মাছ খেতে চাইলে প্রজনন মৌসুমে ওদেরকে কোনো ভাবে বিরক্ত করা চলবে না।
মাছেরা যেন তাদের প্রকৃত জননক্ষেত্রে বংশবৃদ্ধি করতে পারে, সেজন্য সরকারিভাবে দুটি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, প্রধান প্রধান মাছগুলোর প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করতে হবে এবং সেই মৌসুমে নির্দিষ্ট মাছ ধরার উপরে কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। যারা বেআইনিভাবে মাছ ধরবে, তাদেরকে কঠোরভাবে জরিমানা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর জন্য গবেষণাগার বা পর্যবেক্ষণকেন্দ্র তৈরি করতে হবে, যেমনটা করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি’। এসব কেন্দ্রের আওতায় নির্দিষ্ট নদীর পানির গুণমান, মাছের জীবনচক্র, দূষণ সূচক ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী কাজ করে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিকে জরুরি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
ওদের প্রাকৃতিক প্রজননের সুবিধা নিশ্চিত করার পরে আমাদেরকে আরও জরুরি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত নদী বা সাগরে ইচ্ছে মতন ময়লা ফেলানো যাবে না। মাঝেমধ্যে খবরে দেখি যে কিছু মানুষ কক্সবাজারে গিয়ে সমুদ্র সৈকতের অবস্থা পুরো ময়লার ভাগাড় বানিয়ে ফেলেছে। এটা সত্যিই দুঃখজনক। কারণ যেকোনো আবর্জনা বিশেষ করে প্লাস্টিক গলায় আটকে মাছের শ্বাস বন্ধ হয়ে যেয়ে বাজেভাবে মারা যেতে পারে মাছটি। এছাড়াও বেলুন, ফানুস, পেইন্ট, লন ধ্বংসাবশেষ, গাড়ির তেল ইত্যাদিও সমানভাবে মাছের ক্ষতি করে। এভাবে চলতে থাকলে একটি অঞ্চলের বিভিন্ন প্রজাতির মাছেদের জীবন বিপন্ন হয়ে যায় এবং এটি অনেকক্ষেত্রে নিষ্ঠুর বিলুপ্তির কারণও হতে পারে। তাই এসব দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
তবে একটি প্রজাতির মাছকে বাঁচানোর যদি আর কোনো প্রাকৃতিক উপায় না-ই থাকে, সেক্ষেত্রে জীবপ্রযুক্তির একটা জবরদস্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে, যাকে বলে ‘জিন ব্যাংক’। চীন, ভারত, রাশিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে মাছের জন্য এই ধরণের ব্যাংক রয়েছে। বিভিন্ন মাছের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রাখা হয় এই ব্যাংকের মধ্যে। পরবর্তীতে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত স্থানে এগুলো ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। মাছের জিন ব্যাংক সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকেঃ ক্রায়োপ্রিজারভড জিন ব্যাংক এবং লাইভ জিন ব্যাংক। এর মধ্যে ক্রায়োপ্রিজারভড জিন ব্যাংকই অত্যাধিক উন্নত।
আরেকটা ব্যাপার আছে, যেটা নিয়ে সচারচর তেমন কথা হয় না। সেটা হলো, বিদেশী মাছের চাষ করা। এর ফলে দেশী প্রজাতির মাছে কমে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় যে বিদেশী মাছগুলো উচ্চ শ্রেণির খাদক, যেকারণে ওরা দেশী মাছগুলোকে খেয়ে ফেলতো। তাছাড়া জলাশয়ের গভীরতাও আগের চাইতে কমেছে। ফলে অনেক সময় ডিম ছাড়ার মতো উপযুক্ত গভীরতায় মাছগুলো যেতে পারে না। কখনো কখনো আবার কীটনাশকের প্রভাবে মা মাছের প্রজনন যেমন ব্যহত হয়, তেমনি মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও সারযুক্ত পানিতে পোনাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এই ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হয় মূলত দেশী মাছগুলোই।
এতক্ষণের যাবতীয় বিষয় নিজে জানা যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন অন্যকেও জানানো। তাই এসব নিয়ে গণআলোচনা ও লেখালেখি প্রয়োজন। তাহলে সুষ্ঠু আইন প্রয়োগের পাশপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতাও মাছগুলোকে বাঁচাতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে, ভূমিকা রাখবে তাদের সুষ্ঠু বিকাশে। এসকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে আমরা হয়ত আমাদের রুই, মৃগেল আর তেলাপিয়াকে বাঁচাতে পারবো। হয়ত খেতে পারবো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত স্বাদযুক্ত ইলিশ, বোয়াল আর কৈ। আমরা কি পারবো না?
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply