ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে নিউট্রাসিউটিক্যালসের ভূমিকা

নিউট্রাসিউটিক্যালস এমন খাবার বা খাবারের উপাদান, যা আমাদের শরীরকে শুধু পুষ্টি জোগায় না, বরং রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে। সহজ কথায়, এগুলো এমন বিশেষ ধরনের খাবার যা ওষুধের মতো কাজ করে। নিউট্রাসিউটিক্যালস শব্দটি এসেছে দুটি শব্দ থেকে—”নিউট্রিশন” বা পুষ্টি এবং “ফার্মাসিউটিক্যাল” বা ঔষধ। সাধারণত এগুলো প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া যায় এবং মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ এবং সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

আমাদের শরীরে অনেক সময় ক্ষতিকর পদার্থ যেমন ফ্রি র‍্যাডিক্যালস বা মুক্ত মূলক তৈরি হয়। শরীরে মুক্ত মূলকের পরিমাণ বেড়ে গেলে নানারকম ক্ষতি হয় যেমন ডিএনএ ভেঙে যাওয়া, কোষপর্দার ক্ষয় ইত্যাদি। ফলে দেখা দিতে পারে ক্যান্সারসহ জটিলসব রোগ। এই অবস্থার নাম অক্সিডেটিভ স্ট্রেস।নিউট্রাসিউটিক্যালস এই ক্ষতিকর পদার্থগুলোকে দূর করে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এরা শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং বড় বড় রোগ (যেমন ক্যান্সার বা ডায়াবেটিস) থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস বর্তমান বিশ্বের দুটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। আজকে আলোচনা করার চেষ্টা করবো, কীভাবে নিউট্রাসিউটিক্যালস এই রোগগুলোর প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আগেই বলেছি যে নিউট্রাসিউটিক্যালস বলতে এমন খাবার বা খাবারের উপাদান বোঝায় যা ওষুধের মতো কাজ করে। এগুলো ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, প্রোবায়ওটিক এবং বায়োঅ্যাকটিভ কম্পাউন্ডের মতো বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ। যেমন:

  • ভিটামিন সি: এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
  • ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: প্রদাহ কমায়।
  • কারকুমিন (হলুদের উপাদান): অ্যান্টি-ক্যান্সার প্রভাব রয়েছে।
  • রেসভারাট্রল (আঙুরে পাওয়া যায়): অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রদাহনাশক।

নিউট্রাসিউটিক্যালস এর ভুমিকা নিয়ে কথা বলার আগে ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস কি ও কেনো হয় তা নিয়ে কথা বলা যাক। আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক জানেন ই না কেনো তার ডায়াবেটিস বা ক্যান্সার হলো!

ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস দুইটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা বিভিন্ন কারণ থেকে উদ্ভূত হয়। ক্যান্সারের প্রধান কারণ হলো শরীরের কোষের ডিএনএতে মিউটেশন, যা কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায়। এটি জেনেটিক ত্রুটি, যেমন BRCA1 এবং BRCA2 জিনের মিউটেশন দ্বারা হতে পারে। পরিবেশগত কারণ যেমন তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার, বায়ুদূষণ, এবং অতিরিক্ত রেডিয়েশনও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও মদ্যপান ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুনে বাড়ায়। এছাড়া কিছু ভাইরাস, যেমন HPV এবং হেপাটাইটিস ভাইরাস, ক্যান্সারের জন্য দায়ী হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহও ক্যান্সারের একটি বড় কারণ, যা কোষ বিভাজন এবং বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।

ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে, টাইপ ১ এবং টাইপ ২ দুই ধরনের ডায়াবেটিস বিদ্যমান ও এদের কারণও ভিন্ন। টাইপ ১ ডায়াবেটিস অটোইমিউন সমস্যার কারণে হয়, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম প্যানক্রিয়াসের বিটা কোষ ধ্বংস করে, ইনসুলিন উৎপাদন একদম বন্ধ হয়ে যায়। টাইপ ২ ডায়াবেটিস রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এখানে, অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি করে, তবে কোষগুলি ইনসুলিনের প্রতি সাড়া দেয় না। একে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বলা হয়। এই রোগের কারণে, গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করতে পারে না এবং রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ে। স্থূলতা, উচ্চ চর্বি এবং চিনি সমৃদ্ধ খাদ্য, শারীরিক পরিশ্রম না করা, এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, যেমন কর্টিসল বা গ্রোথ হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন, এবং পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমও ডায়াবেটিসে ভূমিকা রাখে।


এখন নিচে ক্যান্সার প্রতিরোধে নিউট্রাসিউটিক্যালস এর ভুমিকা আলোচনা করা হলোঃ

অ্যান্টিঅক্সিডেন্টঃ আন্টিঅক্সিডেন্ট দেহে ফ্রির‍্যাডিক্যালস কমাতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ ভিটামিন-সি এবং -ই, ক্যারোটিনয়েড এবং পলিফেনল সমৃদ্ধ খাবার। এছাড়াও, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ডিএনএ মিউটেশন প্রতিরোধে কার্যকর।

ডিএনএ এর সুরক্ষা নিশ্চিতঃ ডিএনএ এর ক্ষতি যদি সময়মত প্রতিরোধ করা না যায়, তবে তা ক্যান্সার, অটোইমিউন রোগ, এবং বার্ধক্য জনিত সমস্যার মতো বিভিন্ন জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ডিএনএ এর ক্ষতি প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যেমনঃ ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই, বিটা-ক্যারোটিন। গবেষনায় দেখা গিয়েছে যে ভিটামিন-সি এবং -ই-এর সংমিশ্রণ অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে ডিএনএ ভাঙন থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও ফাইটোক্যামিকেল ক্যান্সার প্রতিরোধে দারুণ কাজ করে। ফাইটোকেমিক্যালস উদ্ভিদের মধ্যে পাওয়া যায় এবং এদের ডিএনএ ক্ষতি রোধে অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। যেমনঃ পলিফেনলস, ফ্ল্যাভোনয়েডস। গ্রিন টি’র ক্যাটেচিন পলিফেনলস ডিএনএ ক্ষতি রোধ করে এবং ক্ষয় সারাতে ভূমিকা রাখে।

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসঃ জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস ডিএনএ মেরামতে সহায়ক। সেলেনিয়াম এনজাইমেটিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে ডিএনএ ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও রেসভারাট্রল এবং ক্যাটেচিন (রেড ওয়াইন, মটরশুটি, কালো আঙ্গুর, এপ্রিকট স্ট্রবেরি) ডিএনএ ক্ষতি প্রতিরোধে সাহায্য করে, যা ক্যান্সার গঠনের একটি বড় কারণ।

অ্যাপোপটোসিসঃ কিছু নিউট্রাসিউটিক্যালস অস্বাভাবিক কোষ ধ্বংসে সহায়তা করে। যেমন ব্রকলি ও ক্রুসিফেরাস জাতীয় সবজিতে থাকা সালফোরাফেন। এটি একটি ক্যান্সাররোধী এবং সালফার সমৃদ্ধ যৌগ। সবজি কাটার সঙ্গে সঙ্গে এটা সক্রিয় হয়। কাচা সবজিতে এই সালফোরাফেনের সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া যায়।

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে নিউট্রাসিউটিক্যালসের ভূমিকাঃ

রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রনঃ
নিউট্রাসিউটিক্যালস যেমন ফাইবার, অ্যালফা-লিপোইক অ্যাসিড, এবং ক্রোমিয়াম রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফাইবার গ্লুকোজ শোষণ কমায় এবং ক্রোমিয়াম ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়।

অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজঃ ডায়াবেটিসে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বৃদ্ধি পায়, যা কোষের ক্ষতি করে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ নিউট্রাসিউটিক্যালস যেমন ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই এবং পলিফেনল এই ক্ষতি রোধ করে।

প্রদাহ কমানোঃ ডায়াবেটিসে প্রদাহ একটি বড় সমস্যা। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং কারকিউমিন প্রদাহ কমাতে কার্যকর।

গ্লুকোজ বিপাক নিয়ন্ত্রনঃ নিউট্রাসিউটিক্যালস যেমন ম্যাগনেসিয়াম এবং জিঙ্ক ইনসুলিনের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে।

লিপিড প্রোফাইল ঠিক করাঃ ডায়াবেটিসে লিপিড প্রোফাইলের যেমন কোলেস্টেরলের ভারসাম্য নষ্ট হয়। নিউট্রাসিউটিক্যালস যেমন বেটা-গ্লুকান এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড লিপিড প্রোফাইল ঠিক রাখে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ফল, শাকসবজি,এবং সম্পূরক হিসেবে নিউট্রাসিউটিক্যালস গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, কারকুমিন সাপ্লিমেন্ট নিয়মিত গ্রহণ করলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ৩০% কমে যায়। এছাড়াও ফাইবার ভিত্তিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাদ্য গ্রহণ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ২০-৩০% কমাতে পারে। ২০১২ সালের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কারকিউমিন ডায়াবেটিস প্রতিরোধে প্রাথমিক স্তরে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড লিপিড প্রোফাইল উন্নত করে এবং ব্যথা কমায়, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নিচে কিছু নিউট্রাসিউটিক্যালস এর নাম ও উৎস সম্পর্কে বলা হলো যেগুলো ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস ছাড়াও অন্য কাজেও দক্ষঃ

  • ফাইবারঃ সবজি, ফল, শস্য এর ভালো উৎস।আমাদের রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
  • অ্যালফা-লিপোইক অ্যাসিডঃ পালংশাক, ব্রোকলিতে প্রচুর পরিমান থাকে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমানোতে পটু।
  • কারকুমিনঃ হলুদ কারকুমিনের প্রধান ও অন্যতম উৎস। ব্যাথা কমাতে এর জুড়ি মেলা ভার।
  • ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডঃ মাছ, আখরোট, ফ্লাক্স সিড এ থাকে। এগুলো লিপিড প্রোফাইল উন্নত করতে সহায়তা করে।
  • পলিফেনলঃ ডার্ক চকলেট, বেরি জাতীয় ফল, সবুজ চাতে পলিফেনল পাওয়া যায়।এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।

সুতরাং, নিউট্রাসিউটিক্যালস ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধে একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। এগুলোর সঠিক ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক উৎস থেকে গ্রহণ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সবার উচিত খাদ্যাভ্যাসে নিউট্রাসিউটিক্যালস অন্তর্ভুক্ত করে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তোলা।

তথ্যসূত্রঃ

লেখাটি 194-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. Istiak Bin Karim Avatar
    Istiak Bin Karim

    অসাধারণ, তথ্যবহুল একটি প্রতিবেদন।

  2. Sadia Tabassum Diya Avatar
    Sadia Tabassum Diya

    চমৎকার উপস্থাপনা। সাধারণের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় একটা আর্টিক্যাল।

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো, মাসে একবার। নিউজলেটারে সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading