মিরাবিলিস

১৯০৫ সালকে অ্যানাস মিরাবিলিস বা ‘অত্যাশ্চর্যের বছর’ নামে অভিহিত করা হয়। এমন নামে ডাকার কারণ এ বছর বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন – ব্রাউনিয়ান মোশন, যার মাধ্যমে অণুর অস্তিত্বকে প্রমাণ করেন, ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট, যেই ইফেক্ট ব্যবহার করে আমাদের ক্যামেরাগুলো কাজ করে এবং তৃতীয়টি হলো আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব যার মাধ্যমে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণই বদলে দেন আইনস্টাইন। ১৯১৫ সালে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব কেবলমাত্র ধ্রুব বেগে গতিশীল বস্তুর জন্য কাজ করলেও আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব পরিবর্তনশীল বেগের জন্যও সঠিকভাবে কাজ করে। 

আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব অনুসারে ভর বিশিষ্ট কোনো বস্তু স্থানকালের মধ্যে বক্রতার সৃষ্টি করে। তাই এর পাশে দিয়ে কোনো বস্তু যেতে চাইলে বস্তুর গতিপথ বেঁকে যায়। এমনকি আলোও যখন ভারী কোনো বস্তু যেমন নক্ষত্র কিংবা গ্যালাক্সির পাশ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে তখন তার গতিপথ বেঁকে যাবে। আলোর কণা ফোটনের কোনো ভর নেই, তবে আলোর গতিপথকে অন্য একটি নক্ষত্র বাঁকিয়ে দিতে পারে – আইনস্টাইনের এধরণের বক্তব্য তৎকালীন সময়ের অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাই মেনে নিতে পারেননি। 

অবশেষে ১৯১৯ সালে ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন ও ফ্র্যাঙ্ক ডাইসন সূর্যগ্রহণের সময় সূর্য থেকে আসা আলোর গতিপথ, সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে থাকা চাঁদের কারণে আদৌ বেঁকে যায় কি না তা পরিমাপ করেন এবং দেখতে পান আসলেই আলোকরশ্মির গতিপথ কিছুটা বেঁকে গিয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষণ হতেই প্রথমবারের মতো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। 

ভারী বস্তুর কারণে স্থান-কালের মধ্যে বক্রতার সৃষ্টি হয়। ফলে ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বস্তুর গতিপথ সরলরৈখিক না হয়ে বক্রাকার ধারণ করে। এমনকি আলোকরশ্মিও সরলপথে না যেয়ে সামান্য বেঁকে যায়। ছবি স্বত্ব – কোয়ান্টাম বিটস ডট অর্গ 

লেন্সিং

একটি লেন্সের কথা চিন্তা করুন । উত্তল লেন্সের মধ্যে দিয়ে আলো যাওয়ার সময় আলোকরশ্মি বেঁকে যায় এবং লেন্সের অপরপাশে আলোকরশ্মিগুলো ফোকাস করে একটি প্রতিবিম্ব তৈরি করে। মহাকাশেও এমন লেন্সিং ঘটে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী। উজ্জ্বল কোনো মহাজাগতিক বস্তু (যেমন কোয়াসার) থেকে আলো আমাদের দিকে আসার সময় যদি মাঝে সে ভারী কোনো বস্তু (যেমন গ্যালাক্সি) পায় তাহলে ভারী বস্তুটি একটি লেন্স হিসেবে কাজ করবে। কোয়াসার থেকে আসা আলোকরশ্মিগুলো ভারী গ্যালাক্সির কারণে আইনস্টাইনের সূত্র মেনে বেঁকে যেয়ে একটি ফোকাসে চলে আসবে ও একটি প্রতিবিম্ব তৈরি করবে। শুধু প্রতিবিম্বই তৈরি করবে এমন না, বরং লেন্স যেমন একটি বস্তুকে বড় করে দেখায়, তেমনি ঐ কোয়াসারকেও আমরা বড় আকারে দেখতে পাবো। উচ্চ ভরবিশিষ্ট কোনো মহাজাগতিক বস্তুকে এধরণের লেন্স হিসেবে ব্যবহার করে দূরের কোনো অস্পষ্ট বস্তুকেও স্পষ্ট করে দেখার এ ঘটনাকে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং বলে। একটি নক্ষত্রের ভর খুব কম হওয়ায় এটি যথেষ্ট পরিমাণে আলো সবসময় বাঁকাতে পারে না। তাই অধিকাংশ সময় একটি গ্যালাক্সি বা কোয়াসার এই লেন্স হিসেবে কাজ করে।

আপেক্ষিকতার সাধারণ সূত্রের সাহায্যে হিসাব করে দেখানো যায় যদি দূরবর্তী উজ্জ্বল আলোক উৎস, লেন্সিং করতে সক্ষম এমন গ্যালাক্সি ও আমাদের পৃথিবী একই সরলরেখায় থাকে তাহলে পৃথিবী থেকে ঐ বস্তুকে একটি রিং-এর মত দেখাবে। এই রিং-কে আইনস্টাইনের রিং বলা হয়। লেন্সিং নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমরা পূর্বে করেছি এই ব্লগে

গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর মাধ্যমে মহাকাশের বস্তুর প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়। লেন্সের পিছনে থাকা মহাকাশের বস্তুটি বিশেষ শর্তসাপেক্ষে একটি আইনস্টাইন রিং-এর আকার ধারণ করতে পারে। এরা একই সরলরেখায় না থাকলে বস্তুর একাধিক প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়। 

গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর অস্তিত্ব আসলেই আছে কি না তা দেখার জন্যই ১৯৭০-এর দশকে মাঠে নামেন বিজ্ঞানীদের একটি দল। অবশেষে ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মত পর্যবেক্ষণে অস্তিত্ব মিলে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ইফেক্ট এর। 

লেন্সিং এর কারণে একটি গ্যালাক্সির চারটি প্রতিবিম্ব তৈরি হয়ে আইনস্টাইন ক্রস গঠন করেছে। ছবি স্বত্ব – NASA, ESA এবং STScI

তাদের পর্যবেক্ষণকৃত গ্যালাক্সিগুলোর পিছনের কোনো এক জায়গায়, বহুদূরে অবস্থান করছে 2M1310-1714 নামের একটি কোয়াসার। এই কোয়াসার, গ্যালাক্সিদ্বয় ও আমাদের পৃথিবী একই সরলরেখায় নেই। ফলে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ইফেক্টের কারণে কোয়াসার থেকে আসা আলো বেঁকে যায়। বেঁকে যাওয়া আলো আমাদের পৃথিবীতে এসে কোয়াসারের চারটি প্রতিবিম্ব তৈরি করে এবং দেখতে অনেকটা বৃত্তাকার দেখায়। এটিই ছিল ২০০৯ সালে আবিষ্কৃত আইনস্টাইন রিং। কখনও কখনও চারটি প্রতিবিম্ব মিলে একটি ক্রস চিহ্নের মতো আকৃতি ধারণ করে। তখন তাকে আইনস্টাইন ক্রস নামেও ডাকা হয়।  ১৯৮৫ সালে বিজ্ঞানী জন হুচরা ও তার দল প্রথমবারের মতো আইনস্টাইন ক্রস আবিষ্কার করেন।

জিগজ্যাগ

আইনস্টাইন রিং ও আইনস্টাইন ক্রসের পর এবছর প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন আইনস্টাইন জিগ-জ্যাগ নামে নতুন এক ঘটনার। তাদের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক নামকরা রিসার্চ জার্নাল অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে। আইনস্টাইন জিগ-জ্যাগ হচ্ছে যদি একটি গ্যালাক্সির কারণে লেন্সিং না হয়ে একাধিক গ্যালাক্সির কারণে লেন্সিং হয় তবে আলোক রশ্মিগুলো কয়েকবার বেঁকে যাবে। ফলে আলোকরশ্মিগুলোর গতিপথ কিছুটা জিগ-জ্যাগ আঁকার ধারণ করবে।

দুটি গ্যালাক্সি থাকার কারণে একটি কোয়াসারের ছয়টি প্রতিবিম্ব তৈরি হয়েছে এবং আলোকরশ্মির গতিপথ জিগ-জ্যাগ আঁকার ধারণ করেছে বলে এধরণের ঘটনাকে আইনস্টাইন জিগ-জ্যাগ বলা হয়। ছবি স্বত্ব – ফ্রেডেরিখ দাক্স ও অন্যান্য ২০২৫ 

চিত্রে খেয়াল করুন একটি গ্যালাক্সি ‘গ্যালাক্সি-১’ ছবির মাঝবরাবর আছে। ঐ গ্যালাক্সির পিছনে একটি কোয়াসার আছে। গ্যালাক্সি-১ এর কারণে কোয়াসারের লেন্সিং হয়েছে। ফলে কোয়াসারের ছয়টি প্রতিবিম্ব তৈরি হয়েছে যা A, B, C, D, E ও F দিয়ে দেখানো হয়েছে। 

তবে মজার বাপার হচ্ছে, এখানে আরেকটি গ্যালাক্সিও রয়েছে, ‘গ্যালাক্সি-২’। দ্বিতীয় এই গ্যালাক্সিটিও গ্যালাক্সি ১ – এর পিছনে রয়েছে। গ্যালাক্সি-১ এর কারণে দ্বিতীয় গ্যালাক্সিটিরও লেন্সিং হচ্ছে এবং এরও দুইটি প্রতিবিম্ব তৈরি হয়েছে (লাল রঙের মেঘের মতো দেখতে)। কোয়াসার থেকে আলো আসার পথে দুইটি গ্যালাক্সির কারণেই দুইবার লেন্সিং হয়েছে বিধায় আলোর পথ জিগ-জ্যাগ লাইনের মতো বেঁকে যায় বলে এর এমন নামকরণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। 

কোয়াসারের ছয়টি প্রতিবিম্ব সম্বলিত এই গ্যালাক্সির ছবি বিজ্ঞানীরা যখন প্রথমবার দেখতে পেয়েছিলেন, তারা ভেবেছিলেন এটি অন্য কোনো লেন্সিং সিস্টেমের মতোই একটি সাধারণ লেন্সিং সিস্টেম। তবে বিজ্ঞানীরা কোয়াসারের ছয়টি প্রতিবিম্ব লেন্সিং সিস্টেম দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারলেও লাল রঙা দেখতে ঐ দুটো অজানা বস্তুর অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না। তাই গতবছর বিজ্ঞানীদের আরেকটি দল এই ছবিটিকে পুনরায় বিশ্লেষণ করেন। বিশ্লেষণে উঠে আসে লাল রঙা এটি আসলে আরেকটি গ্যালাক্সি যা ছবির মাঝে থাকা গ্যালাক্সির কারণেই লেন্সিং হয়েছে। 

ছবিটিকে পুনরায় বিশ্লেষণকারী ১৯ জন বিজ্ঞানীদের সে দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বাংলাদেশী জ্যোতির্বিজ্ঞানী আনওয়ার জামান সজীব। ড. আনওয়ার জামান সজীব ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন ও একজন নাসা আইনস্টাইন ফেলো। 

আইনস্টাইন জিগজ্যাগ আবিষ্কার করার মাধ্যমে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পক্ষে আরেকটি প্রমাণ পাওয়া গেল। এছাড়াও এধরণের লেন্সিং সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের সৃষ্টির সূচনালগ্নে জন্মানো নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলোকে আরো স্পষ্টভাবে দেখতে সক্ষম হবো এবং আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টির ব্যাপারে আরও নানা রহস্যের সমাধান করতে পারব। 

তথ্যসূত্র 







বিজ্ঞান নিউজলেটার

যুক্ত হোন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান নিউজলেটারে!
আমরা সাপ্তাহিক ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। 
এ নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। থাকবে নতুন লেখার খবরও।


Loading

লেখাটি 0-বার পড়া হয়েছে।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখা

  • আইনস্টাইন জিগজ্যাগ

    আইনস্টাইন জিগজ্যাগ

  • ডাইনোসর বিলুপ্ত না হলে কেমন হতো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

    ডাইনোসর বিলুপ্ত না হলে কেমন হতো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

  • মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ  অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

    মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

  • আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

    আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

  • ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

    ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

  • কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!

    কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply