কোন দম্পতির ক্ষেত্রে যখন স্ত্রী গর্ভবতী হয় তখন ঐ দম্পতিকে দেখলে সকলের একটি সাধারণ প্রশ্ন হলো “ছেলে হবে নাকি মেয়ে?”। এই প্রশ্নের কারণ হলো, সামাজিক জীবনের অভিজ্ঞতায় আমরা বলতে পারি যে ছেলে বা মেয়ে হওয়ার সম্ভাবনা ৫০/৫০। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে মেয়ে বা ছেলে হওয়ার সম্ভাবনা কেনই বা ৫০/৫০ হলো? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের লিঙ্গ নির্ধারণ পদ্ধতিতে।
আমাদের এই প্রাণিজগতে নানা বৈচিত্রের জনন প্রক্রিয়া ও জীবনচক্র লক্ষ করা যায়। কোন প্রাণী অযৌন জনন, কোনটা যৌন জনন, কোনটা আবার যৌন অযৌন উভয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রজনন সম্পন্ন করে । যৌন জননের ক্ষেত্রে মাইয়োসিস বিভাজনের মাধ্যমে ডিপ্লয়েড (2n) প্রাণিদেহ থেকে হ্যাপ্লয়েড (n) জনন কোষ সৃষ্টি হয়। দুটি হ্যাপ্লয়েড (n) জনন কোষের মিলনের ফলে সৃষ্ট জাইগোট (2n) থেকে নতুন প্রাণীর বিকাশ ঘটে। সচল (ফ্লাজেলার মাধ্যমে চলনে সক্ষম) জননকোষটিকে বলা হয় পুংগ্যামিট বা শুক্রাণু এবং নিশ্চল জননকোষটিকে বলা হয় স্ত্রীগ্যামিট বা ডিম্বাণু।
অনেক প্রাণীর ক্ষেত্রেই যৌন দ্বিরূপতা/Sexual Dimorphism (স্ত্রী ও পুরুষ প্রাণির ভিন্ন বাহ্যিক গঠন) পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে একটিকে বলা হয় স্ত্রী অপরটিকে বলা হয় পুরুষ।
তাহলে কিভাবে একই প্রজাতির কিছু প্রাণী পুরুষ আবার কিছু প্রাণী স্ত্রী ?
সাধারণত দুটি প্রধান প্রক্রিয়ায় লিঙ্গ নির্ধারিত হয় –
১। ক্রোমোসোমাল পদ্ধতি
২। পরিবেশগত প্রভাব
১। ক্রোমোসোমাল পদ্ধতিঃ
এই পদ্ধতি প্রাণিদেহে বিদ্যমান ক্রোমোসোম দ্বারা বাহিত জিন তার লিঙ্গ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে । যেসকল ক্রোমোসোম লিঙ্গ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে এদের বলা হয় সেক্স ক্রোমোসোম (Sex Chromosome)। সেক্স ক্রোমোসোম স্ত্রী ও পুরুষ প্রাণীতে ভিন্ন ধরণের হয়। সেক্স ক্রোমোসোমে বিদ্যমান সুনির্দিষ্ট জিন নির্দিষ্ট যৌনগত (স্ত্রীলিঙ্গ বা পুংলিঙ্গ) বাহ্যিক গঠনের জন্য দায়ী। যেসকল ক্রোমোসোম লিঙ্গ নির্ধারণে নিষ্ক্রিয় এবং স্ত্রী ও পুরুষ প্রাণীতে অভিন্ন এদের অটোসোম (Autosome) বলে।
এক্ষেত্রে ৪ ধরণের ক্রোমোসোমাল পদ্ধতি পাওয়া যায়ঃ
ক) XX-XY পদ্ধতিঃ অধিকাংশ স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে প্রাণীর লিঙ্গ XX-XY পদ্ধতি অনুযায়ী জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষের লিঙ্গ নির্ধারণ পদ্ধতি হিসেবে XX-XY পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। নতুন প্রাণীতে এক্ষত্রে এক জোড়া সেক্স ক্রোমোসোম থাকে, যার একটি মাতা থেকে আগত এবং অন্যটি পিতা থেকে। মাতা-পিতা উভয়েই X ক্রোমোসোম প্রদান করলে প্রাণীটি হয় মেয়ে (XX)। অন্যদিকে মাতা X ক্রোমোসোম এবং পিতা Y ক্রোমোসোম প্রদান করলে প্রাণীটি হয় ছেলে (XY)। সুতরাং এ পদ্ধতিতে পুরুষ (XY) প্রাণীটি হয় হেটারোগ্যামেটিক/Heterogametic (অর্ধেক জনন কোষ X এবং অর্ধেক জনন কোষ Y ক্রোমোসোম বহন করে)। হেটারোগ্যামেটিক পুরুষ বা মেল বলতে তাই XY ক্রোমোজম-বিশিষ্ট পুরুষ প্রাণী বোঝায় যাদের যৌন-ক্রোমোজম দুইটি ভিন্ন। অন্যদিকে স্ত্রী (XX) প্রাণীটি হল হোমোগ্যামেটিক/Homogametic (সকল জনন কোষ X ক্রোমোসোম বহন করে)। যেহেতু মাতা জনন কোষে শুধুমাত্র X ক্রোমোসোম প্রদান করতে সক্ষম কিন্তু পিতা জনন কোষে X অথবা Y ক্রোমোসোম প্রদান করতে পারে সেহেতু সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে তা নির্ভর করে পিতা তার জনন কোষে X ক্রোমোসোম প্রদান করল নাকি Y ক্রোমোসোম। তাই এই পদ্ধতিতে পিতা সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য দায়ী। সকল স্তন্যপায়ী, কতক পতঙ্গ ও সরিসৃপ-এ এই লিঙ্গ নির্ধারণ পদ্ধতি পাওয়া যায়। সাধারণত হ্যাপ্লয়েড জননকোষ (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) দিয়ে এই লিঙ্গ নির্ধারিত হয়।
খ) ZZ-ZW পদ্ধতিঃ সাপ ও পাখিতে দেখায় যায় উল্টো ঘটনা। নতুন প্রাণীতে এক্ষত্রে এক জোড়া সেক্স ক্রোমোসোম থাকে, যার একটি মাতা থেকে আগত এবং অন্যটি পিতা থেকে। মাতা-পিতা উভয়েই Z ক্রোমোসোম প্রদান করলে প্রাণীটি হয় ছেলে (ZZ)। অন্যদিকে মাতা W ক্রোমোসোম এবং পিতা Z ক্রোমোসোম প্রদান করলে প্রাণীটি হয় মেয়ে (ZW)। এ পদ্ধতিতে স্ত্রী (ZW) প্রাণীটি হয় হেটারোগ্যামেটিক (অর্ধেক জনন কোষে Z এবং অর্ধেক জনন কোষে W ক্রোমোসোম বিদ্যমান। অন্যদিকে পুরুষ (ZZ) প্রাণীটি হল হোমোগ্যামেটিক (সকল জনন কোষে Z ক্রোমোসোম বিদ্যমান)। লিঙ্গ নির্ধারণের এই পদ্ধতি হলো ZZ-ZW পদ্ধতি। এটি XX-XY পদ্ধতির সম্পুর্ণ বিপরীত হওয়ায় এর এমন নামকরণ করা হয়েছে। এদের ক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্ধারণে পিতার পরিবর্তে মাতা দায়ী। কারণ পিতা জনন কোষে শুধুমাত্র Z ক্রোমোসোম প্রদান করতে সক্ষম কিন্তু মাতা জনন কোষে Z অথবা W ক্রোমোসোম প্রদান করতে পারে তাই সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে তা নির্ভর করে মাতা তার জনন কোষে Z ক্রোমোসোম প্রদান করল নাকি W ক্রোমোসোম। । সাপ, পাখি, প্রজাপতি, কতক উভচর প্রাণি ও মাছে এ পদ্ধতিতে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়।
গ) XX-XO পদ্ধতিঃ ঘাসফড়িং, তেলাপোকা, ঝিঁঝিঁ পোকা সহ কতক পতঙ্গে এ পদ্ধতিতে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে স্ত্রী (XX) প্রাণীতে থাকে দুটি X ক্রোমোসোম এবং পুরুষ (XO) প্রাণীতে থাকে শুধুমাত্র একটি X ক্রোমোসোম। কোন Y ক্রোমোসোম থাকেনা বলে Y ক্রোমোসোমের অনুপস্থিতিকে শূন্য (O) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। কোন প্রকার পুংগ্যামিট ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করল তাই দিয়ে এই পদ্ধতিতে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। যদি পুংগ্যামিটে X ক্রোমোসোম থাকে তবে ডিম্বাণুর একটি X ক্রোমোসোমের সাথে একত্রিত হয় জাইগোটে দুটি X ক্রোমোসোম হবে, ফলে প্রাণীটি হবে স্ত্রী (XX)। অন্যদিকে যদি পুংগ্যামিটে কোন X ক্রোমোসোম না থাকে তবে ডিম্বাণুর একটি X ক্রোমোসোমের সাথে মিলিত হয়ে জাইগোটে একটিমাত্র X ক্রোমোসোম হবে। ফলে প্রাণীটি হবে পুরুষ (XO)। এ পদ্ধতিতে স্ত্রী প্রাণী হল হোমোগ্যামেটিক/Homogametic এবং পুরুষ প্রাণিটির কোষের স্ত্রী প্রাণী অপেক্ষা একটি ক্রোমোসোম কম থাকবে (যেহেতু পুরুষ XO এবং স্ত্রী XX)।
ঘ) হ্যাপ্লোডিপ্লয়ডি (Haplodiploidy): নাম থেকেই বুঝা যাচ্ছে এটি হল হ্যাপ্লয়েড (n) ও ডিপ্লয়েড (2n) এর একিভূতকরণ। পতঙ্গের Hymenoptera গোত্রে (মৌমাছি, পিঁপড়া) এ পদ্ধতিতে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। কোষে বিদ্যমান ক্রোমোসোম সেট সংখ্যা লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য দায়ী। এই পদ্ধতি অনুযায়ী অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে পুরুষ (n) প্রাণী বিকাশ লাভ করে ফলে এরা হ্যাপ্লয়েড (n) হয় অর্থাৎ পুরুষদের কোষে ক্রোমোসোম সেট সংখ্যা এক। অন্যদিকে নিষিক্ত ডিম্বাণু (n+n) থেকে স্ত্রী (2n) প্রাণী বিকাশ লাভ করায় এরা হয় ডিপ্লয়েড (2n) অর্থাৎ কোষে দুই সেট ক্রোমোসোম বিদ্যমান। এই পদ্ধতির একটি মজার দিক হল পুরুষ প্রাণীর কোন পিতা ও পুত্র থাকা সম্ভব না। শুধুমাত্র নানা ও নাতি থাকা সম্ভব। এটা কিভাবে সম্ভব?
কারণ পুরুষ প্রাণী হ্যাপ্লয়েড এবং এরা শুধুমাত্র মাতার অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে সৃষ্ট। তার জিনোমের সমগ্র অংশ এসেছে মাতা থেকে। তাই তার কোন পিতা থাকা সম্ভব না। তার পুত্র সম্ভব না কারণ তার শুক্রাণু ও স্ত্রী’র ডিম্বাণু মিলিত হলে যে নিষিক্ত ডিপ্লয়েড ডিম্বাণু গঠিত হয় তা থেকে শুধুমাত্র স্ত্রী প্রাণী বিকাশ লাভ করে। পুরুষ প্রাণীর নানা থাকা সম্ভব কারণ নানা ও নানীর জনন কোষ এর নিষিক্ত হওয়ার ফলে সৃষ্ট মাতা থেকে যে অনিষিক্ত ডিম্বাণু আসে তা থেকেই সে জন্ম লাভ করে। ঠিক উল্টোভাবেই তার নাতি থাকা সম্ভব।
অন্যদিকে Drosophila melanogaster বা ফ্রুট ফ্লাই এর লিঙ্গ ক্রোমোসোম দ্বারা নির্ধারিত হলেও উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো থেকে তা আলাদা। এদের ক্ষেত্রে X এবং Y ক্রোমোসোম উপস্থিত থাকলেও XX-XY পদ্ধতিতে এদের লিঙ্গ নির্ধারিত হয় না । এদের দেহে মোট ৪ জোড়া ক্রোমোসোম থাকে। লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে Y ক্রোমোসোমের কোন ভূমিকা নেই। বরং X ক্রোমোসোম ও অটোসোমের সংখ্যার অনুপাত দ্বারা এদের লিঙ্গ নির্ধারিত হয়।
তালিকায় দেখা যাচ্ছে যে অটোসোমের সংখ্যা X ক্রোমোসোম থেকে অধিক হলে সেটি হয় পুরুষ এবং X ক্রোমোসোম অটোসোম থেকে অধিক হলে সেটি হয় স্ত্রী । অর্থাৎ স্ত্রী মাছির জন্য এক্স ক্রোমোসোম দ্বায়ী হলেও পুরুষ মাছির জন্য দ্বায়ী হল অটোসোম।
আরও একটি মজার ব্যতিক্রম হল প্লাটিপাস এর লিঙ্গ নির্ধারণ। সেই আদিকাল থেকেই প্লাটিপাস ছিল বিজ্ঞানীদের নিকট এক বিস্ময়ের নাম। এদের জীবন্ত জীবাশ্ম বলা হয়। এদের যেমন রয়েছে স্তন্যপায়ীদের মত লোমশ দেহ, উষ্ণ রক্ত ও শিশুকালে মায়ের স্তন পানের মত স্বভাব তেমনি রয়েছে পাখিদের মত দাঁতবিহীন চঞ্চু এবং সরিসৃপের মত নখর ও বিষ নিঃসরণ ক্ষমতা। সব মিলিয়ে প্লাটিপাস হল স্তন্যপায়ী, পক্ষীকূল এবং সরিসৃপের এক মিলবন্ধন। তাদের অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্টের মত তাদের সেক্স ক্রোমোসোম ও লিঙ্গ নির্ধারণও অদ্ভুত। এদের দেহে মোট ক্রোমোসোম সংখ্যা ৫২ যার মাঝে সেক্স ক্রোমোসোম হল ১০ টি। স্ত্রী প্লাটিপাসে থাকে ১০ টি X ক্রোমোসোম এবং পুরুষ প্লাটিপাসে থাকে ৫টি X ক্রোমোসোম ও ৫ টি Y ক্রোমোসোম । মায়োসিস বিভাজনের সময় এমনভাবে দলবেঁধে সেক্স ক্রোমোসোম সঞ্চারিত হয় যেন ডিম্বাণুতে ৫ টি X ক্রোমোসোম গমন করে এবং অর্ধেক শুক্রাণুতে ৫টি X ক্রোমোসোম এবং বাকি অর্ধেকে ৫টি করে Y ক্রোমোসোম প্রবেশ করে। শুক্রাণু ও ডিম্বানুর মিলনের ফলে সেক্স ক্রোমোসোমের অবস্থা ভিত্তিতে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়।
২। পরিবেশগত প্রভাবঃ
অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেক্স ক্রোমোসোম দ্বারা লিঙ্গ নির্ধারিত হলেও অনেক প্রাণীর ক্ষেত্রেই লিঙ্গ নির্ধারণে ক্রোমোসোমাল কোন ভূমিকা থাকে না। লিঙ্গ নির্ধারিত হয় পারিপার্শিক পরিবেশের কোন নিয়ামকের দ্বারা । যেমন –
কিছু কিছু সরিসৃপ ও মাছের প্রজাতিতে তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। প্রাণীটির ডিম যে তাপমাত্রায় থাকে তাই নির্ধারণ করে ডিমের ভিতর থাকা প্রাণীটি স্ত্রী হবে নাকি পুরুষ। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত লিঙ্গ নির্ধারনে তিনটি ধরণ এখন পর্যন্ত লক্ষ করা যায়।
ঘটনা ১ – এক্ষেত্রে ডিমের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কম হলে নতুন প্রাণীটি হয় স্ত্রী এবং বেশি হলে প্রাণীটি হয় পুরুষ ,উদাহরণঃ কচ্ছপ।
ঘটনা ২ – এক্ষেত্রে ডিমের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের তাপমাত্রা নির্দিষ্ট তাপমাত্রার বেশি হলে নতুন প্রাণীটি হয় স্ত্রী এবং কম হলে পুরুষ, উদাহরণঃ টুয়াটারা।
ঘটনা ৩ – এক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের তাপমাত্রা নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কাছাকাছি হলে হয় পুরুষ এবং তাপমাত্রা ঐ তাপমাত্রার কম বা বেশি হলে হয় স্ত্রী, উদাহরণঃ কুমির
পরিবেশগত প্রভাবে লিঙ্গ নির্ধারণে আরও বৈচিত্র্য দেখা যায় এক প্রকার সামুদ্রিক শামুক (Crepidula fornicata) এ। এরা কোন একটি জড় বস্তুকে ভিত্তি করে একটি শামুকের উপর আরেকটি এঁটে বসে স্তুপাকারে বসবাস করে। এদের জীবনচক্রের প্রথম দিকে মুক্ত সাঁতারু লার্ভা দশা দেখা যায়। যেই লার্ভাটি সর্ব প্রথম কোন জড় ভিত্তির সংস্পর্শে আসে সেটি সেখানে আবাস স্থাপন করে এবং স্ত্রী প্রাণী হিসেবে বৃদ্ধি লাভ করে। পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় সেই স্ত্রী শামুকটি এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা অন্যান্য লার্ভাকে আকৃষ্ট করে, ফলে নতুন আরেকটি লার্ভা তার উপর এসে অবস্থান করে। কিন্তু এক্ষেত্রে উপরে অবস্থা করান নতুন লার্ভাটি পুরুষ হিসেবে বৃদ্ধি লাভ করে। ফলে স্ত্রী ও পুরুষ শামুকের মাঝে প্রজননের ফলে আরও নতুন লার্ভা জন্মলাভ করে । মজার বিষয় হল একটি নির্দিষ্ট সময় পর উপরে থাকা পুরুষ শামুকটি হরমোনাল পরিবর্তনের মাধ্যমে স্ত্রী শামুকে রূপান্তরিত হয়। ফলে সেও নিচের শামুকটির মত রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যার ফলে অন্য আরও নতুন লার্ভা আকৃষ্ট হয়ে তার উপর অবস্থান করে এবং পুরুষ শামুক হিসেবে বৃদ্ধি করে। তাদের মধ্যে প্রজনন হয়। পূর্বের ন্যায় ঘটনা পর্যায়ক্রমে আরও ঘটতে থাকে। এ পদ্ধতিকে অনুক্রমিক উভলিঙ্গতা (Sequential Hermaphroditism) বলে।
প্রতিটি স্তুপে ১২ বা তার অধিক শামুক অবস্থান করে। সবার উপরে থাকা শামুকটি হয় পুরুষ বাকি সকল শামুক হয় স্ত্রী (চিত্র দ্রষ্টব্য)। এভাবে স্তুপে শামুকের অবস্থান দ্বারা এদের লিঙ্গ নির্ধারিত হয়।
ট্রপিক অঞ্চলের মাছ, ক্লাউন ফিশের ক্ষেত্রে লিঙ্গ এতটা দ্রুত নির্ধারিত হয় না। সকল ক্লাউন ফিশ পুরুষ হিসেবে জীবন শুরু করে। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এরা স্ত্রী-তে রূপান্তরিত হয়। এই মাছগুলো ছোট গোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করে। এসব গোষ্ঠীতে সুনির্দিষ্ট কর্তৃত্ব ক্রমধারা নির্ধারিত থাকে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটা গোষ্ঠীতে সবচেয়ে প্রভাবশালী স্ত্রী ও পুরুষই শুধুমাত্র প্রজনন করতে পারবে। অবাক করা বিষয় হল, যদি কোনভাবে প্রভাবশালী স্ত্রী মাছটি মারা যায় তবে সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী পুরুষ মাছটি লিঙ্গ পরিবর্তনের মাধ্যমে স্ত্রী মাছে রূপান্তরিত হয় এবং গোষ্ঠিতে মৃত স্ত্রী মাছটির অবস্থান দখল করে। অন্যদিকে ক্রমিক ধারা অনুযায়ী অন্য একটি পুরুষ মাছ এসে লিঙ্গ পরিবর্তন করা পুরুষ মাছটির জায়গা দখল করে।
সবচেয়ে অদ্ভুত লিঙ্গ নির্ধারণের ঘটনা দেখা যায় চাবুক-লেজি গিরগিটি-তে। সকল চাবুক-লেজি গিরগিটি স্ত্রী লিঙ্গের অধিকারী। তারপরেও এরা ডিম পারে এবং কোন যৌন জনন ছাড়াই সন্তান উৎপাদন করতে সক্ষম। পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় প্রতিটি চাবুক-লেজি গিরগিটি যে ডিম পারে এবং তা থেকে আরেকটি ক্লোন স্ত্রী গিরিগিটি বৃদ্ধি লাভ করে।
উপরে বর্ণিত সকল লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য ক্রোমোসোম বা পরিবেশগত নিয়ামক দায়ী হলেও বস্তুত লিঙ্গ নির্ধারিত হয় সুনির্দিষ্ট জিন দ্বারা। ক্রোমোসোমাল লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেক্স ক্রোমোসোমে বিদ্যমান নির্দিষ্ট জিন লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য প্রকৃত ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে পরিবেশগত নিয়ামক দ্বারা লিঙ্গ নির্ধারিত হলেও প্রকৃতপক্ষে ঐ নিয়ামক নির্দিষ্ট জিনকে বন্ধ বা চালু করে ফলে ঐ প্রকাশিত বা বাধাপ্রাপ্ত জিনের দ্বারা লিঙ্গ নির্ধারিত হয়।
মানুষের লিঙ্গ নির্ধারণঃ
মানুষের লিঙ্গ XX-XY পদ্ধতিতেই নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং Y ক্রোমোসোম পুরুষ হওয়ার জন্য দায়ী।
X ক্রোমোসোমঃ এটি ১৫৩ মিলিয়িন বেস পেয়ার নিয়ে গঠিত এবং প্রায় ৮০০ প্রোটিন কোডিং জিন বিদ্যমান। উভয় লিঙ্গের মানুষের জন্য অপরিহার্য জিন এই ক্রোমোসোমে বিদ্যমান। স্বাভাবিক বিকাশের জন্য উভয়েরই কমপক্ষে একটি করে X ক্রোমোসোম প্রয়োজন।
Y ক্রোমোসোমঃ এটি ৫৯ মিলিয়ন বেস পেয়ার নিয়ে গঠিত এবং মাত্র ৭০ টি প্রোটিন কোডিং জিন বিদ্যমান। Y ক্রোমোসোমে বিদ্যমান বিশেষ SRY জিন শুক্রাশয় গঠনের জন্য দ্বায়ি। XY সেক্স ক্রোমোসোম জোড় বিশিষ্ট ভ্রূনদেহে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের সময় এই জিনটি সক্রিয় হয় ফলে শুক্রাশয় গঠন শুরু হয়। এই জিন X ক্রোমোসোমে থাকে না তাই Y ক্রোমোসোমের অনুপস্থিতিতে স্ত্রী লিঙ্গ বিকাশ লাভ করে।
তথ্যসূত্রঃ
১। Concepts Of Genetics by William S. Klug, Michael R. Cummings,
Charlotte A. Spencer, Michael A. Palladino
২। Genetics, A Conceptual Approach by Ben Pierce
৩। youtube.com/watch?v=kMWxuF9YW38
Leave a Reply