X ক্রোমোসোম এর রহস্য উন্মোচন


লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

ধরুন দুটি আইডেন্টিক্যাল জমজ বোন আছে। আইডেন্টিক্যাল জমজ মানে এরা দুইজন একটিমাত্র জাইগোট থেকে বৃদ্ধি লাভ করেছে। যেহেতু তারা সম্পূর্ণ একই রকম ডিএনএ বিশিষ্ট্য তাই তাদের চুলের রঙ, নাক, হাত, চোখের রঙ সহ প্রায় সব কিছুই হুবুহু একই রকম। কিন্তু আশ্চর্য করা বিষয় হল এদের মাঝে একজন সবুজ আলোর জন্য বর্ণান্ধ কিন্তু অন্যজন স্বাভাবিক।

আইডেন্টিক্যাল জমজ বোন। image source : twinpickle.com

প্রশ্ন হলো ,একই রকম জিনোম বিশিষ্ট্য হলে দুই বোনের মাঝে এই ভিন্নতা কিভাবে সম্ভব হলো ?

উত্তর লোকানো আছে তাদের জিনে এবং X ক্রোমোসোম এর বিশেষ রহস্যে। মানব দেহে ২৩ জোড়া ক্রোমোসোম আছে। আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্যট নিয়ন্ত্রনকারী সকল উপাদান ২৩ জোড়া ক্রোমোসোম রূপে দেহের প্রতিটি কোষে বিন্যস্ত আছে। প্রতিটি ক্রোমোসোম প্রোটিন ও ডিএনএ এর সমন্বয়ে গঠিত। আমার প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জান দায়ী হলো জিন। আর এই জিন হলো ডিএনএ এর নির্দিষ্ট খণ্ডাংশ যা কোষকে নির্দিষ্ট কোন প্রোটিন গঠনের নির্দেশনা প্রদান করে। ভিন্ন ভিন্ন জিন ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন এর জন নির্দেশ দেয়। ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন এর ফলে ভিন্ন ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়। ২৩ জোড়া ক্রোমোসোমে প্রতিজোড়া ক্রোমোসোম এর ক্ষেত্রে একটি আসে মাতা থেকে (মাতৃক) এবং অন্যটি আসে পিতা থেকে (পৈতৃক)।

৪৬টি ক্রোমোসোমের অর্ধেক এসেছে মাতা থেকে, অর্ধেক পিতা থেকে image source : osmosis.org

মজার বিষয় হলো, ২২ নং জোড়া পর্যন্ত প্রতি জোড়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেক ক্রোমোসোম অনুরূপ জিনের সেট বহন করে। উদাহরণ হিসেবে বললে, আমাদের ৯ নং ক্রোমোসোমে ABO বাল্ড গ্রুপ জিন বিদ্যমান। এক্ষত্রে ৯ নং ক্রোমোসোম জোড়ার উভয় ক্রোমোসোমে একই স্থানে (লোকাস) এই ABO ব্লাড গ্রুপ জিন রয়েছে। জিন দুটি (অ্যালিল) একই বৈশিষ্ট্যের (ব্লাড গ্রুপ) হলেও এদের বহিঃপ্রকাশ বা রূপ আলাদা হতে পারে। যেমন, যদি এক ক্রোমোসোমে A ব্লাড গ্রুপের জিন এবং অন্য ক্রমোসোমে B ব্লাড গ্রুপের জিন থাতে পারে। এখানে অ্যালিল দুটি একই বৈশিষ্ট্য, ব্লাড গ্রুপের জন্য হলেও এদের বহিঃপ্রকাশ বা রূপ আলাদা। এই একই জিনের দুটি আলাদা রূপের কারণ হলো মিউটেশন। এই মিউটেশন হয়ত বহু প্রজন পূর্বে হয়েছিল। এ ধরণের মিউটেশন এর মাঝে কোনটা হয় নিষ্ক্রিয়, কোনটা আবার ক্ষতিকারক রোগ সৃষ্টি করে, কোনটা আবার সুবিধাজনক অভিযোজন এর জন্য দায়ী। উপরের কথাগুলো থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আমরা প্রতিটি জিনের জন্য দুটি রূপ বহন করি। যার একটি মাতা থেকে প্রাপ্ত এবং অন্যটি পিতা থেকে। একই জিনের রূপ দুটির একটিকে অপরটির অ্যালিল বলে। প্রতিটি জিনের ক্ষেত্রে দুটি রূপ (একটি মাতা থেকে, অন্যটি পিতা থেকে) বলেই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে মাতা পিতা উভয়ের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথম ২২ জোড়া এই নিয়ম মেনে চললেও ২৩ নং জোড়াটি ভিন্ন ও স্বকীয়। এখানেই লোকানো আছে আইডেন্টিক্যাল জমজ বোনের বর্ণান্ধতা রহস্য। ২৩ নং ক্রোমোসোম জোড়কে বলে সেক্স ক্রোমোসোম। কারণ এই ক্রোমোসোম জোড় লিঙ্গ নির্ধারণ এর জন্য দায়ী। মেয়েদের ক্ষেত্রে ২৩ নং ক্রোমোসোমে থাকে দুটি X ক্রোমোসোম (XX) এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে থাকে একটি X ও একটি Y ক্রোমোসোম (XY)। Y ক্রোমোসোমে SRY জিন থাকে যা ছেলেদের শুক্রাশয় গঠনের জন্য দায়ী। অন্যদিকে X ক্রোমোসোম মেয়েদের লিঙ্গ নির্ধারণের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্নায়তন্ত্রের গঠন, ঐচ্ছিক পেশির ক্রিয়া, চোখে আলোক সংবেদী কোষ সহ আরও অনেক অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্যের জিন বহন করে। পুরুষের ক্ষেত্রে XY ক্রোমোসোম জোড় থাকায় একটি X ক্রোমোসোম তথা X ক্রোমোসোমের জিন সমূহের একটিমাত্র সেট/কপি বহন করে। তাঈ মানবদেহ এক্ষেত্রে পূর্বের ২২ জোড়ার ন্যায় প্রতিটি জিনের জন্য দুটি কপি না থাকা সত্যেও শুধুমাত্র একটি কপি নিয়ে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে XX জোড় বিশিষ্ট্য মেয়েদের ক্ষেত্রে। ছেলেদের মত করে যদি মেয়েদের কোষে দুটি X ক্রোমোসোম সমানভাবে কার্যকর থাকে তবে ভ্রূনদেহে অস্বাভাবিকত্ব দেখা দিবে। এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে X-নিষ্ক্রিয়াকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

X-নিষ্ক্রিয়করণ পদ্ধতি। image source : scoop.it

XX ক্রোমোসোম জোড় বিশিষ্ট্য ভ্রূণে, ভ্রূণীয় বিকাশের শুরুর দিকে X-নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি কোষে একটি করে X ক্রোমোসোম নিষ্ক্রিয় হয়। X-নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়াটি অনেকটা এলোমেলো পদ্ধতি, যার ফলে কোন কোষে মাতৃক না পৈতৃক X ক্রোমোসোম নিষ্ক্রিয় হবে তা নির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত নয়। ভ্রূণের কোষগুচ্ছের কোন কোষ হয় মাতৃক X ক্রোমোসোম নিষ্ক্রিয় করবে, পার্শ্ববর্তী অন্য কোষ হয়ত আবা পৈতৃক X ক্রোমোসোম নিষ্ক্রিয় করবে। নিষ্ক্রিয়করণের পর নিষ্ক্রিয় X ক্রোমোসোমটি বার বডি (Barr Body) নামক গঠন লাভ করে। এই গঠন লাভের পর নিষ্ক্রিয় ক্রোমোসোমের কোন জিন প্রকাশ লাভ করতে পারে না। বার বডি গঠনের পর যখন ভ্রূণদেহের কোষগুলো বিভাজিত হয় তখন কোষগুলো তাদের ভিতরে একটি নিষ্ক্রিয় X ক্রোমোসোম দশা সহ বিভাজিত হয়। যার ফলে শুধুমাত্র মাতৃক X ক্রোমোসোম বহনকারী কোষ থেকে বিভাজনের ফলে সৃষ্ট সকল কোষে শুধুমাত্র মাতৃক X ক্রোমোসোম সক্রিয় থাকে এবং শুধুমাত্র পৈতৃক X ক্রোমোসোম বহনকারী ক্রোমোসোমের বিভাজনের ফলে সৃষ্ট সকল থাকে পৈতৃক X ক্রোমোসোম। এখন মাতৃক ও পৈতৃক X ক্রোমোসোমে যদি কোন একটি জিনের দুটি ভিন্ন রূপ থাকে তবে মাতৃক X ক্রোমোসোম বিশিষ্ট্য কোষগুলোতে জিনের এক রূপ এবং পৈতৃক X ক্রোমোসোম বিশিষ্ট্য কোষগুলোতে অন্য রূপ প্রকাশ লাভ করবে। এরূপ ঘটনা দেখা যায় মেয়ে ক্যালিকো বিড়ালের গায়ের লোমে।

X-নিষ্ক্রিয়করণ এর মাধ্যমে ক্যালিকে বিড়ালের গায়ে সৃষ্ট প্যাটার্ন image source : khanacademy.org

এদের গায়ের লোমের প্যাটার্ন নির্ভর করে কোন ত্বকীয় কোষে কোন X ক্রোমোসোম সক্রিয় অবস্থায় আছে। এদের একটি X ক্রোমোসোম বহন করে  কমলা লোমের জিন এবং অন্য X ক্রোমোসোম বহন করে কালো লোমের জিন। ত্বকের যেসকল কোষে কমলা লোমের জিন বহনকারী X ক্রোমোসোম সক্রিয় থাকে সেসকল জায়গায় লোম হয় কমলা রঙের এবং যে জায়গার কোষগুলোতে কালো লোমের জিন বহকারী X ক্রোমোসোম সক্রিয় থাকে সে সকল জায়গায় লোম হয় কালো রঙের। এখন আমরা বর্ণান্ধ আইডেন্টিক্যাল জমজ বোনের রহস্য উনোচন করতে পারব। এদের একটি X ক্রোমোসোমে মিউটেশনের ফলে চোখের আলোক সংবেদী কোষের জিন, সবুজ আলোর জন্য বর্ণান্ধতা বহন করে এবং অন্য X ক্রোমোসোমটি স্বাভাবিক আলোক সংবেদী কোষের জিন বিদ্যমান। এদের মাতার দেহে জাইগোট এ X-নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়ার পূর্বেই এটি আলাদা হয়ে দুটি পৃথক ভ্রূণ গঠন করে। ফলে প্রতিটি ভ্রূণের কোষে বিদ্যমান দুটি X ক্রোমোসোমের একটি স্বাভাবিক এবং অন্যটি সবুজ বর্ণান্ধতার জিন বহন করে। পরবর্তীতে দুটি ভ্রূণে পৃথকভাবে X-নিষ্ক্রিয়করণ শুরু হয়। যে ভ্রূণের কোষে স্বাভাবিক X ক্রোমোসোম নিষ্ক্রিয় (সবুজ বর্ণান্ধতায় X ক্রোমোসোম সক্রিয়) হয়ে যায় সে ভ্রূণ থেকে বিকাশ লাভ করা বোনটি বর্ণান্ধ হয়। অন্যদিকে যে ভ্রূণের কোষে সবুজ বর্ণান্ধতা বহনকারী X ক্রোমোসোম নিষ্ক্রিয় (স্বাভাবিক X ক্রোমোসোম সক্রিয়) হয়ে যায় সে ভ্রূণ থেকে বিকাশ লাভ করা বোনটি হয় স্বাভাবিক।

এলোমেলো X-নিষ্ক্রিয়করণ পদ্ধতির ফলে একই জিনোম বিশিষ্ট্য দুই জমজ বোনের একজন হতে পারে স্বাভাবিক অন্যজন বর্ণান্ধ। image source : slideplayer.com

মানুষের কিছু রোগ X ক্রোমোসোমে বিদ্যমান জিনের মিউটেশনের ফলে হয় (যেমন, বর্ণান্ধতা, হিমোফিলিয়া)। X ক্রোমোসোম দ্বারা বাহিত এই রোগ সমূহ XX ক্রোমোসোম বিশিষ্ট্য মেয়েদের ক্ষেত্রে কম প্রকট হয়। কারণ তাদের দেহে X-নিষ্ক্রিয়করণ এর ফলে যে সকল কোষে মিউট্যান্ট জিন বহনকারী X ক্রোমোসোম সক্রিয় থাকে শুধুমাত্র সে সকল কোষগুলোই আক্রান্ত হবে। আর স্বাভাবিক X ক্রোমোসোম বহনকারী কোষগুলো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে। রোগের তীব্রতা তখন নীর্ভ০র করে কোন অঙ্গের কোষ আক্রান্ত্র হলো তার উপর। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে X ক্রোমোসোম দ্বারা বাহিত রোগের তীব্রতা সব সময় বেশি হয়। কারণ ছেলেদের কোষে শুধুমাত্র একটি X ক্রোমোসোম থাকে এবং কোন X-নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়া থাকে না। তাই ছেলেদের X ক্রোমোসোমে যদি রোগ সৃষ্টিকারী মিউট্যান্ট জিন থাকে তবে তা সমগ্র দেহে প্রকাশিত হয়।

সবশেষে বলা যায়, এই X-নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়া দ্বারা প্রমাণিত হয় যে জিন একাই আমাদের বৈশিষ্ট্যভিত্তিক সকল গল্পের ব্যাখ্যা দিতে পারেনা ।

তথসূত্রঃ

www.youtube.com/watch?v=veB31XmUQm8

লেখাটি 2,597-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Response

  1. দারুণ লেখা। এটা আসলে এপিজেনেটিক্স কিভাবে কাজ করতে পারে তার একটা চমৎকার উদাহরণ।

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading