কোভিড-১৯ যখন বিশ্বব্যাপী তার একচ্ছত্র সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে, সে সময় চিকিৎসক, নার্সদের পাশাপাশি বিজ্ঞানীরাও বসে নেই। তারাও জানার চেষ্টা করছেন সার্স-কভ-২ (SARS-CoV-2) ভাইরাসের নানা দিক। সারা বিশ্বে জৈবপ্রযুক্তি অত্যন্ত গতিশীল হওয়াতে অল্প সময়ের ভিতর দেশে দেশে রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া ভাইরাস এর জেনোম সিকোয়েন্সিং করে তা সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে ভাইরাসের বিভিন্ন প্রোটিন এর প্রাথমিক গাঠনিক তথ্য যাকে আমরা এমিনো এসিড সারি (amino acid sequence) বলি। এছাড়া এই প্রোটিন গুলোর কোন কোন টির ত্রিমাত্রিক গঠনও বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে বের করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বায়োইনফরমেটিক্স এর নানা রকম টুলস ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা আরো কিছু বিষদ ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। চীনের দুজন গবেষক বায়োইনফরমেটিক্স এর প্রয়োগ করে সার্স, মার্স এবং সার্স-কভ-২ ভাইরাসের এপিটোপের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন (1)। খুব সাধারণ ভাবে বললে এপিটোপ হলো ভাইরাসের বাইরের কোন প্রোটিন এর একটি অংশ যেটা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শনাক্ত করতে জানে এবং সেটাকে পূনরায় চেনার জন্য এন্টিবডি তৈরীতে সাহায্য করে।
সার্স-কভ-২ কে সার্স করোনাভাইরাসের (SARS-CoV) সবচে কাছের বোন বলা যায়। এ দুই ভাইরাসের নিউক্লিওটাইড বা RNA তুলনা করে দেখা গেল তাদের ৭৯.৫% নিউক্লিওটাইড হুবহু মিলে যায়। দুটি ভাইরাস ই মানবদেহে কোষের যে রিসেপ্টর প্রোটিনে (ACE-2) সংযুক্ত হয়ে কোষের ভিতর প্রবেশ করে সেটিও এক। তাই তারা ধারণা করলেন হয়তো সার্সের জন্য ইতিমধ্যে যেসব ঔষধ মানুষের উপর পরীক্ষার শেষ ধাপে আছে সেগুলো হয়তোবা সার্স-কভ-২ এ কাজ করতে পারে। একদল বিজ্ঞানী সার্স ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন কে শনাক্ত করতে সক্ষম এরকম চার টি মনোক্লোনাল এন্টিবডি সার্স-কভ-২ এ প্রয়োগ করে দেখলেন। ফলাফলে একটি মাত্র এন্টিবডি কাজ করলো, বাকি তিনটি নয়। এ থেকে বোঝা গেলো যে নতুন এই ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের এপিটোপে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে তাই বাকি এন্টিবডি গুলো তাকে সনাক্ত করতে পারছেনা।
বিষয়টাকে আরেকটু গভীর ভাবে দেখার জন্য বিজ্ঞানীরা সার্স, মার্স এবং সার্স-কভ-২ এর স্পাইক প্রোটিনের সারি তুলনা করলেন। এতে দেখা গেলো সার্স-কভ-২ এর স্পাইক প্রোটিনের প্রায় ২৪.৫ শতাংশ সার্স এর স্পাইক প্রোটিন থেকে আলাদা যাকে বলা হয়ে থাকে নন-কনজার্ভড অংশ। তারা ধারণা করলেন হয়তো এই নন-কনজার্ভড অংশেই নতুন এপিটোপ গুলোর আবির্ভাব হয়ে থাকতে পারে। তো তারা এপিটোপের অবস্থান কে তিনটা সম্ভাব্য ভাগে ভাগ করলেনঃ কনজার্ভড অংশ, নন-কনজার্ভড অংশ আর এই দুই অংশের মিশ্রণ আছে এমন অংশ। এপিটোপ বাছাই করতে তারা দুই ধাপে কাজ করলেন। স্পাইক প্রোটিনের এমিনো এসিডের সারি কে বিশ্লেষণ করে সফটওয়্যার বলতে পারে কোন কোন জায়গা সম্ভাব্য এপিটোপ। ডাটাবেজে থাকা পূর্বের অসংখ্য এপিটোপ থেকে তথ্য নিয়ে সফটওয়্যার এই সম্ভাব্য এপিটোপ বের করার কাজটি করে। একে বলা হয় এমিনো এসিডের সারি থেকে এপিটোপের সম্ভাব্যতা যাচাই, যা সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা হয়। বেশী এপিটোপ স্কোর মানে সেটার এপিটোপ হিসাবে কাজ করার সম্ভাবনা বেশী। সার্স, মার্স এবং সার্স-কভ-২ এর স্পাইক প্রোটিনের এপিটোপ স্কোর থেকে দেখা গেলো মার্সের এপিটোপ স্কোর তুলনামূলক ভাবে সবচে বেশী, তারপর সার্স-কভ-২ এবং সর্বশেষে সার্স। অর্থাৎ এদের এপিটোপ স্কোরের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র লক্ষনীয়। এপিটোপ স্কোর আবার সরাসরি এন্টিজেনিসিটির সাথে সম্পর্কিত, অর্থাৎ ঐ এপিটোপগুলো এন্টিজেন হিসাবে আমাদের শরীরে কতটা সবল ও সফল সেটাকে বলে এন্টিজেনিসিটি।

এপিটোপ স্কোর ছাড়াও তারা আরেকটি বিষয় দেখলেন, সেটা হলো এই এপিটোপ গুলোর সারফেস এক্সেসিবিলিটি বা এগুলো কতখানি উপরিভাগে উন্মুক্ত। কারন এটা না হলে মানব শরীরে এন্টিজেন শনাক্ত করার কাজে নিয়োজিত কোষগুলো এই অংশগুলোর নাগাল পাবেনা এবং এদের সাথে বন্ধন স্থাপন করতে পারবেনা। বিশ্লেষণ করে দেখা গেলো নন-কনজার্ভড জায়গার এপিটোপ গুলোর এপিটোপ স্কোর অপেক্ষাকৃত বেশী। বেশী স্কোরের সমস্ত এপিটোপ গুলো তিনটি ভাইরাসের ক্ষেত্রে তুলনায় দেখা গেলো একটি এপিটোপ ও নাই যা তিনটি ভাইরাসেই এক সাথে বিদ্যমান। কেবল সার্স এবং সার্স-কভ-২ এর ভিতর ৫ টি এপিটোপ কমন পাওয়া গেলো। মানে এই পাঁচটি এপিটোপ দুই ভাইরাসেই উপস্থিত আছে। বাকি এপিটোপ গুলো প্রতি ভাইরাসের ক্ষেত্রে একেবারেই অনন্য যা অন্য কারো ভিতর নাই। সার্সের ক্ষেত্রে ৮৩.৯% এপিটোপ একেবারেই অনন্য, অন্যদিকে সার্স-কভ-২ এর ৮৫.৩% এপিটোপ ই অনন্য। পাশাপাশি এটাও তারা দেখলেন, সার্স-কভ-২ এর এই অনন্য এপিটোপ গুলোর আবার ৯২.৭% অবস্থান করে নন-কনজার্ভড অথবা কনজার্ভড-নন-কনজার্ভড মিশ্রিত অংশে।
এর পরের ধাপে তারা সার্স-কভ-২ এর স্পাইক প্রোটিনের সাথে এর রিসেপটর এসিই-২ এর বন্ধন কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করলেন (2)। তাতে রিসেপটর বাইন্ডিং করার জায়গায় (RBD বা রিসেপটর বাইন্ডিং ডোমেইন) তারা মোট সাত টি এপিটোপ পেলেন, যার ছয় টি অনন্য এবং কনজার্ভড-নন-কনজার্ভড এর মিশ্রনে সেই এপিটোপগুলো গঠিত। এছাড়াও বায়োইনফর্মেটিক্স বিশ্লেষণ করে এপিটোপ স্কোর আর বাইরের দিকে তাদের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে মোট ১১ টা এপিটোপের ভিতর ২ টা পাওয়া গেলো রিসেপটর বাইন্ডিং ডোমেইন এ। সবশেষে তারা দেখলেন বেশী স্কোরের এপিটোপগুলোর ৯০.৯% ই নতুন এবং অনন্য। হয়তো এই নতুন এপিটোপ গুলোই সার্স ভাইরাস কে পরিবর্তিত করে নতুন প্রাণঘাতি সার্স-কভ-২ এর দিকে নিয়ে গেছে। এসব থেকে তারা আশা করছেন হয়তো এই নতুন এপিটোপগুলোর তথ্য এন্টিবডি ভিত্তিক ঔষধ বা ভ্যাক্সিন তৈরীর ক্ষেত্রে কাজে আসবে। পাশাপাশি এটাও আন্দাজ করা যাচ্ছে যে অন্যান্য কারনের পাশাপাশি নতুন এই এপিটোপ গুলোর জন্যই সার্স-কভ-২, সার্স এর থেকেও বেশী এন্টিজেনিসিটি দেখিয়ে সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছে। তবে শংকার কথা এই যে, এরই মধ্যে দেশে দেশে যখন সংক্রমণ চলছে তখন ভাইরাসের মিউটেশন বা নিজেকে পালটানো থেমে নেই। এমনকি এই রিসেপটর বাইন্ডিং ডোমেইন অংশেও পরিবর্তন হচ্ছে। তাই বিজ্ঞানীদের জন্য এটা অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ এই পরিবর্তনরত ভাইরাস এর জন্য এন্টিবডি বা ভ্যাক্সিন এর কাজ এগিয়ে নেয়া।
তথ্যসূত্রঃ
1. Zheng M, Song L. Novel antibody epitopes dominate the antigenicity of spike glycoprotein in SARS-CoV-2 compared to SARS-CoV. Cell Mol Immunol. 2020;
2. Yan R, Zhang Y, Li Y, Xia L, Guo Y, Zhou Q. Structural basis for the recognition of SARS-CoV-2 by full-length human ACE2. Science (80- ). 2020;
Leave a Reply