আপনার কোভিড-১৯ এর উপসর্গ বিদ্যমান। টেস্ট করালেন। রিপোর্ট হাতে পেয়ে দেখলেন রিপোর্ট নেগেটিভ। নিঃসন্দেহে খুশি হবেন। খুশিতে বাড়ি ফিরে নির্দ্বিধায় জড়িয়ে ধরলেন প্রিয়জনদের। দূরত্ব বজায় রেখে চলার প্রয়োজন বোধ করলেন না। দিনকয়েকের মধ্যেই আপনার প্রিয়জনদের উপসর্গ দেখা দিল এবং তাদের টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ আসলো! আপনি আসলে করোনা আক্রান্ত হবার পরেও রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছিল, এটাকেই বলা হয় ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট। করোনা টেস্টে পজিটিভ আসার চেয়েও ভয়াবহ ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট।
আসুন জানার চেষ্টা করি কেন এবং কীভাবে এটি ঘটতে পারে।
১। আপনার নমুনাটি ঠিকভাবে সংগ্রহ করা হয়নি। সঠিক মিডিয়ায় নমুনাটি রাখা হয়নি।
২। আপনার স্যাম্পল থেকে ভাইরাল RNA ঠিকভাবে বের করে আনা (Extraction) হয়নি। অথবা RNA নষ্ট হয়ে গেছে। পদ্ধতির ভিন্নতার কারণে বের করে আনা RNA এর পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে।
৩। Real Time Quantitative Reverse Transcription Polymerase Chain Reaction সংক্ষেপে Real Time qRT-PCR বা rRT-PCR ঠিকভাবে হয়নি।
২ এবং ৩ নাম্বার সমস্যা সমাধানের জন্য এক্সট্রাকশন কন্ট্রোল, পজিটিভ কন্ট্রোল, নেগেটিভ কন্ট্রোল, ইনটার্নাল কন্ট্রোল প্রভৃতি বিভিন্ন ধরণের কন্ট্রোলের ব্যবহার করা হয়। যাতে কোন একটা ধাপে সমস্যা হলে তা ধরা যায়।
আবার, সব rRT-PCR কিটের সংবেদনশীলতা (Sensitivity) সমান না। ভাইরাল জিনোমের সংখ্যা ঘনত্ব কম হলে অনেক কিট ব্যবহারে রেসাল্ট নেগেটিভ আসতে পারে। [৬]।
এবার আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটিতে। ধরুন উপরের সবকিছুই সঠিকভাবে হয়েছে এবং খুবই অভিজ্ঞ এবং দক্ষ কেউ আপনার টেস্ট করেছে। তারপরেও আপনি ফলস নেগেটিভ ফলাফলপেতে পারেন।
নমুনা হিসেবে upper and lower respiratory specimens (যেমন nasopharyngeal ও oropharyngeal swabs, sputum, bronchoalveolar lavage ইত্যাদি) গুলোই মূলত ব্যবহার করা যায়। আমাদের দেশে নাকের ভেতরের দিক থেকে ন্যাসোফ্যারেঞ্জিয়াল অথবা গলার ভেতরের দিক থেকে ওরোফ্যারেঞ্জিয়াল সোয়াব সংগ্রহ করা হয়। rRT-PCR নিঃসন্দেহে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই দুটো সোয়াবে ভাইরাসের উপস্থিতি সবসময় নাও থাকতে পারে। জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন, সেন্টার ফর এভিডেন্স বেইজড মেডিসিন, আলজাজিরা ও ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদনে এই দুই সোয়াবে ৭০% বা তার কম ক্ষেত্রে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেছে বলে দাবী করা হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পাবার ০-৭ দিন তুলনামূলক ভালো কার্যকারিতা দেখালেও দিন বৃদ্ধির সাথে সাথে এই দুই নমুনা থেকে সনাক্ত করার হার কমে গেছে। তবে bronchoalveolar lavage (ফুসফুসীয় তরল) এবং Sputum এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো ফলাফল প্রদান করেছে দাবী করা হয়। [১,২,৩,৭]
বোঝাই যাচ্ছে আক্রান্ত হবার পরে বিভিন্ন ধরণের নমুনাতে সময় ভেদে ভাইরাসের উপস্থিতির ভিন্নতা আছে। এক্ষেত্রে, বেশ কয়েকধরণের নমুনা একত্র করে পরীক্ষা করলে সনাক্তকরণে সহায়ক হতে পারে, তবে তা গবেষণার দাবী রাখে। পাশাপাশি বুকের সিটি স্ক্যানও কোভিড ডিটেকশনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে বলে কিছু গবেষক দাবী করেন [৪,৫] তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, rRT-PCR ই এখনও পর্যন্ত কোভিড-১৯ সনাক্তকরণে সবচাইতে কার্যকর পদ্ধতি। কিন্তু তাতেও অল্প হলেও ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট আসার সম্ভাবনা আছে। তাই বিশেষজ্ঞরা যে নির্দেশনা দেন, তা হল “Negative results do not preclude SARS-CoV-2 infection and should not be used as the sole basis for patient management decisions. Negative results must be combined with clinical observations, patient history, and epidemiological information.” অর্থাৎ, নেগেটিভ রেসাল্টকে কোন ক্রমেই রোগী ব্যবস্থাপনা সিদ্ধান্তের একমাত্র ভিত্তি হিসেবে ধরা যাবে না এর সাথে ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষণ, উপসর্গ, রোগীর ইতিহাস এবং রোগ-বিস্তার সংক্রান্ত তথ্য সবই বিবেচনায় আনতে হবে। [৬]
এইজন্য, উপসর্গ থাকলে টেস্টে নেগেটিভ আসলেও অবশ্যই ডাক্তারের পরমর্শ মেনে নিজ থেকে ৭ দিন আইসোলেশনে (বাকিদের থেকে আলাদা) থেকে উপসর্গসমূহ পর্যবেক্ষণ করা উচিৎ।
এবারে র্যাপিড সেরোলজিক্যাল টেস্টের ব্যাপারে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। কোন জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এন্টিবডি উৎপাদন শুরু করে। এন্টিবডি গুলো আসলে প্রোটিন। র্যাপিড টেস্টে আসলে রক্তে এই এন্টিবডি প্রস্তুত হয়েছে কি না সেটা পরীক্ষা করে। এটি সহজ, সস্তা এবং তুলনামূলক অনেক কম দক্ষতার প্রয়োজন হয়। সমস্যা হচ্ছে রক্তে এন্টিবডি তৈরি হতে একটা নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন হয় এবং তা আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপরেও নির্ভর করে। বিখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় গবেষকদের দাবী লক্ষণ প্রকাশ পাবার ৭ দিন পরে পরীক্ষা করে মাত্র ৫০% ক্ষেত্রে এন্টিবডি পাওয়া গেছে। এবং ১৪ তম দিনে ১০০% ক্ষেত্রে এন্টিবডি পাওয়া যায়।[৭] যদিও খুব অল্প সংখ্যক রোগীর উপরে পরীক্ষাটা চালানো হয়েছে তথাপি এটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। ব্যাপারটা ধরতে পারছেন? লক্ষণ প্রকাশ পাবার ০-৭ দিনের মধ্যে যদি কেউ এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে তার ফলস নেগেটিভ আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি (৫০%)।
এবং প্রথমে বর্ণিত ঘটনার মত এই ক্ষেত্রেও আক্রান্ত হয়নি ভেবে প্রচুর মানুষকে আক্রান্ত করার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। যা পরিস্থিতিকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। তাই এগুলো মাথায় রেখেই শুধুমাত্র হাসপাতাল এবং গবেষণাগারগুলোতে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিৎ। IgG এন্টিবডি তৈরি হবার পর অনেকদিন শরীরে থেকে যায়। তাই কতজন ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেছে এটা জানার উপায় হিসেবেও এ টেস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। সেরোলোজিক্যাল টেস্টের একটা বিশেষ ব্যবহার আছে। আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে গেলে কিন্তু PCR এ নেগেটিভই আসবে। সেরোলজিক্যাল টেস্ট সেক্ষেত্রে নিশ্চিত হবার একমাত্র উপায়। তবে এধরণের টেস্ট অনুমোদন দেওয়ার আগে বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার গাইডলাইন কঠোরভাবে মানা উচিৎ। উল্লেখ্য, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো এধরণের র্যাপিড টেস্ট কিট অনুমোদন করেনি।
তথ্যসূত্রঃ
১। জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন
২। সেন্টার ফর এভিডেন্স বেইজড মেডিসিন
৩। আলজাজিরা
৪। রেডিওলজি জার্নাল
৫। কোরিয়ান জার্নাল অব রেডিওলজি
৬। ল্যাবরেটরি করপোরেশন অব আমেরিকা
৭। ন্যাচার জার্নাল
লেখক সৈয়দ মুক্তাদির আল সিয়াম চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন এর গবেষক এবং বর্তমানে কোভিড-১৯ সনাক্তকরণ দলের সাথে কর্মরত
Leave a Reply