ভারী নক্ষত্র তার জীবনকালের একদম শেষে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে তার সকল পদার্থ মহাকাশে ছড়িয়ে দিয়ে মৃত্যুবরণ করে। আর এই বিস্ফোরণকেই আমরা বলি সুপারনোভা। গত ২০২১ এ ন্যাচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটা প্রবন্ধে নতুন একধরনের সুপারনোভার সন্ধান দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা এটার নাম দিয়েছেন “ইলেক্ট্রন-ক্যাপচার সুপারনোভা”।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গ্রাজুয়েট ছাত্র ডাইচি হিরামাটচু (Daichi Hiramatsu) গ্লোবাল সুপারনোভা প্রজেক্টের একজন সদস্য, যেখানে সারা পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা ডজনের উপর টেলিস্কোপ দিয়ে সুপারনোভা নিয়ে কাজ করছেন। ডাইচি এবং তার দল পৃথিবী থেকে ৩১ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি NGC2146 তে অবস্থিত SN 2018zd সুপারনোভাকে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, SN 2018zd সুপারনোভাটি আসলে ইলেকট্রন ক্যাপচার সুপারনোভা।
এখন ইলেকট্রন ক্যাপচার সুপারনোভাকে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে ইলেকট্রন ক্যাপচার জিনিসটা কি আর সুপারনোভা সম্পর্কে বিস্তারিত।
প্রথমে আসি সুপারনোভার দিকে, একটি নক্ষত্রের মধ্যে দুটো প্রক্রিয়া চলতে থাকে একটি হলো নক্ষত্রের কেন্দ্রে মহাকর্ষের আকর্ষণজনিত চাপ আর অন্যটি হলো কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। এই মহাকর্ষ নক্ষত্রের কেন্দ্রে চাপ দেয় আর নিউক্লিয়ার ফিউশনে উৎপন্ন চাপ আগের চাপের উল্টো দিকে কাজ করে আর এজন্যই নক্ষত্র গোলাকার হয়।কিন্ত নক্ষত্রের শেষ বয়সে নক্ষত্রের জ্বালানী কমে আসে আর এর নিউক্লিয়ার ফিউশনের হারও কমে যায় তখন এর উর্ধ্বমুখী চাপ কমে আসে। আর চাপের ব্যালেন্সের এই ব্যত্যয়ে নক্ষত্রটি বিস্ফোরিত হয় যাকে আমরা বলি সুপারনোভা।
সুপারনোভা প্রধানত দুই ধরনের: টাইপ-১ আর টাইপ-২।
টাইপ-১ সুপারনোভা হল মূলত থার্মোনিউক্লিয়ার। এটি ঘটে জোড়া-নক্ষত্রের ক্ষেত্রে। কোনো বিশাল নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে যদি কোনো ছোটো নক্ষত্র ঘুরতে থাকে, তবে ছোটো নক্ষত্রটির আকর্ষণে বড় নক্ষত্র থেকে পদার্থ ছোটো নক্ষত্রে চলে আসে। এক্ষেত্রে তাপের একটা ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর ছোট নক্ষত্রটি ফেটে পরে সুপারনোভা ঘটায়। এধরনের সুপারনোভা সূর্যের চেয়ে আটগুণ বা তার চেয়ে ছোটোনক্ষত্রের ক্ষেত্রে হয়।
অন্যদিকে টাইপ-২ সুপারনোভা ঘটে সূর্যের চেয়ে দশগুণ বড় নক্ষত্রের ক্ষেত্রে। এই সকল নক্ষত্রগুলোর শেষ বয়সে এদের কেন্দ্রে নানা ভারী পদার্থের জন্ম হতে থাকে যেমন, অক্সিজেন, ম্যাগনেশিয়াম, লোহা। এগুলো তৈরী হতে গিয়ে নক্ষত্রটি তার বেশির ভাগ জ্বালানি শেষ করে ফেলে আর আগেই বলেছি জ্বালানি শেষ হলে কিভাবে বিস্ফোরণ ঘটে। এই সুপারনোভা শেষেই তৈরী হয় ব্ল্যাকহোল আর নিউট্রন নক্ষত্র।
এখন প্রশ্ন এসে যায়, সূর্যের চেয়ে আটগুণ বা তার নিচের ভরের নক্ষত্রে ঘটে টাইপ-১ আর দশগুণের বেশি ভরে ঘটে টাইপ-২; তাহলে এদের মাঝামাঝি থাকা নক্ষত্রগুলোতে কী ঘটে? এই মাঝামাঝি ভরের নক্ষত্রেই ঘটে ইলেকট্রন ক্যাপচার সুপারনোভা। তাই একে বলা হয় টাইপ-১ এবং টাইপ-২ এর মধ্যকার “মিসিং-লিংক“। এই সুপারনোভা এমন ভরের নক্ষত্রে হয় যারা বিশাল নক্ষত্র বটে, তবে ওতটাও বিশাল নয়। কারণ এরা এতো বিশাল নয় যে, এরা তাদের কেন্দ্র থাকা অক্সিজেন আর ম্যাগনেশিয়ামকে লোহাতে পরিণত করতে পারে।
এখন বোঝা দরকার এই ইলেকট্রন ক্যাপচার জিনিসটা কি?
আমরা জানি একটি পরমাণুতে থাকে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। ইলেকট্রন ক্যাপচার-এর বিষয়টা হলো, কোনো পরমাণুতে যদি নিউট্রনের চেয়ে প্রোটন সংখ্যা বেশি থাকে তাহলে ঐ পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন তার চারিদিকে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনকে ক্যাপচার করে বা বন্দি বানিয়ে ফেলে। আর এই ইলেকট্রন আর প্রোটনের সংঘর্ষে তৈরী হয় নিউট্রন। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, এই প্রক্রিয়াতে পরমাণুর ভর সংখ্যা কিন্তু কমে না। কারণ একটি প্রোটন শুধু নিউট্রনে রূপান্তর হয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে কমে পারমাণবিক সংখ্যা, কারণ একটি প্রোটন কমে যাচ্ছে।
ইলেক্ট্রন-ক্যাপচার সুপারনোভাতেও এই একই ঘটনা ঘটে। এখানে নক্ষত্রের কেন্দ্রে থাকা ম্যগনেশিয়াম বা অক্সিজেনের প্রোটন ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে নিয়নে পরিণত হতে থাকে। এই ইলেক্ট্রনগুলোই নক্ষত্রের কেন্দ্রের মহাকর্ষের চাপের বিপরীতে কাজ করে ব্যালেন্স রাখতো। কিন্তু যখন এদের সংখ্যা কমে আসতে থাকে, তখনই এই চাপের ব্যালেন্স হারিয়ে যায় আর নক্ষত্র বিস্ফোরিত হয়।
এই ইলেকট্রন ক্যাপচার সুপারনোভার তত্ত্বটি প্রথম প্রদান করেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেনিচি নোমোটো (Ken’ichi Nomoto) ১৯৮০ সালে। তার মতে, সেই সকল নক্ষত্রেই এধরনের সুপারনোভা হবে, যাদের ভর বিশাল হলেও পর্যাপ্ত নয়, বিস্ফোরণের আগে ভর হারাবে, অস্বাভাবিক রাসায়নিক বিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাবে। তার তত্ত্ব দেওয়ার ৪০ বছর পর ডাইচি ও তার দল এর সত্যতা প্রমাণ করলেন। ডাইচি 2018zd সুপারনোভা বিস্ফোরিত হয় ২০১৮ সালে। তার আগের ছবি আর পরের ছবি মিলিয়ে নোমোটোর দেওয়া ধারণার মিল পাওয়া গিয়েছে। আর এই সিদ্ধান্তে পৌছানো হয়েছে যে এটা আসলে ইলেকট্রন ক্যাপচার সুপারনোভা। ডাইচির মতে, এই আবিষ্কার হয়তো ১০৫৪ সালে ঘটা সুপারনোভা, যেটা পৃথিবী থেকে দেখা গিয়েছিল। যার আলো দিনের আকাশে ২৩ দিন আর রাতে ২ বছর পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল। ডাইচির মতে ক্রাব নেবুলার সৃষ্টি এই ইলেকট্রন ক্যাপচার সুপারনোভার সাহায্যেই। তাই হয়তো আশা করা যায়, সামনে ডাইচি ও তার দল এই সুপারনোভা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য বের করে আনবে।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply