Taxis এবং Nomos শব্দদ্বয় থেকে উৎপত্তি লাভ করা Taxonomy শব্দটি দ্বারা আমরা বুঝি জীবের শ্রেণিবিন্যাস। উদ্ভিদ, প্রাণী কিংবা অন্য কোনো জীবের বৈশিষ্ট্য নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের অনেককেই ট্যাক্সোনোমি বা শ্রেণিবিন্যাসের মৌলিক জ্ঞানকে সাথে নিয়ে চলতে হয়। দে ক্যান্ডল কর্তৃক ব্যবহৃত এই শব্দটির পরিধি ব্যাপক। তাই বিভিন্ন বিজ্ঞানী একে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সিম্পসন এর মতে, জীবের শ্রেণিবিভাগের (Classification) এর ভিত্তি, উদ্দেশ্য, নিয়ম-কানুন ইত্যাদি বিষয়ের সমষ্টিগত রূপ বা আলোচনা হলো শ্রেণিবিন্যাস (Taxonomy)। তবে মায়ার আরো সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা প্রদান করেছিলেন। তিনি শ্রেণিবিভাগ বা Classification সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ও আলোচনার ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক দিককে “শ্রেণিবিন্যাস” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই দুই বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর দেওয়া সংজ্ঞার সাথে আজকের ট্যাক্সোনমির বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
শ্রেণিবিন্যাসের গুরুত্ব
শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা দু-চার লাইনে লিখে দিতে পারলেও এর পরিধি ব্যাপক। ট্যাক্সোনমির মাধ্যমে আমরা অনায়াসেই অল্প সময়ে অধিক সংখ্যক জীব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পারি। যেকোনো গ্রুপ বা দলের জীব নিয়ে গবেষণার জন্য ট্যাক্সোনমি অতীব জরুরি। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, শ্রেণিবিন্যাস সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও জ্ঞানের মাধ্যমে বিলুপ্ত জীবের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। আপনি যদি সংকরায়ন নিয়ে কাজ করতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই জীবের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে।
ট্যাক্সোনমির সবথেকে আকর্ষণীয় দিকটি হলো এর মাধ্যমে একই সাথে একাধিক জীবের বৈশিষ্ট্য জেনে যাওয়া যায়। এছাড়াও শ্রেণিবিন্যাসের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো উদ্ভিদকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করা সম্ভবপর হয়। এককথায় জীবের বাসস্থান, ইতিহাস, বাস্তুসংস্থান কিংবা অঙ্গসংস্থান নিয়ে গবেষণা করতে অথবা সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ট্যাক্সোনমির জ্ঞান অত্যন্ত জরুরি। একারণেই বোধ হয়, অষ্টম শ্রেণি থেকে শুরু করে মাস্টার্সের বইয়েও শ্রেণিবিন্যাস বা ট্যাক্সোনমির আলোচনা করা হয়।
শ্রেণিবিন্যাস বনাম শ্রেণিবিভাগ বনাম শ্রেণিবদ্ধতা
বিজ্ঞানের যেকোনো আলোচনায় হঠাৎ করে একটা শাখার মধ্যে আরেকটা শাখা কীভাবে যেন ঢুকে যায়! যার কারণে অনেকেই ঐ দু’টোর মধ্যে পার্থক্য বের করতে পারে না। এমনই একটি গণ্ডগোলের জায়গা হলো ট্যাক্সোনমি বা শ্রেণিবিন্যাস। অনেকে একে শ্রেণিবিভাগ (Classification) এবং শ্রেণিবদ্ধতা(Systematic) এর সাথে গুলিয়ে ফেলে। দেখতে এই তিনটাকে একই রকম মনে হলেও ভেতরের মশলায় বেশ তফাৎ!
সিম্পসন ১৯৬১ সালে এই তিনটির চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, যা থেকে পার্থক্যগুলো খুব সহজেই বেরিয়ে আসে। তাঁর মতে শ্রেণিবিভাগের (Classification) ভিত্তি, লক্ষ্য, নিয়মকানুন, জীবের নামকরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনাকে শ্রেণিবিন্যাস বা ট্যাক্সোনমি বলা হয়। আর শ্রেনিবিভাগ বা Classification হলো বিশেষ নিয়ম বা পদ্ধতি অনুসারে জীবদেরকে নির্দিষ্ট দল বা গ্রুপে বিভক্ত করা। অন্যদিকে শ্রেণিবদ্ধতা বা Systematic হলো জীবজগতের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, পার্থক্য, স্বভাব ইত্যাদির সামষ্টিক আলোচনা বা পর্যালোচনা। অর্থাৎ শ্রেণিবদ্ধতার সীমানা অনেক বড়। এই পুরো খিচুড়ি থেকে যে গন্ধটা পাওয়া যায় তা হলো, শ্রেণিবিভাগ শ্রেণিবিন্যাসের এবং শ্রেণিবিন্যাস শ্রেণিবদ্ধতার আলোচনার অংশবিশেষ। সুতরাং, এই তিনটিকে পরিধি বা সীমানার ক্রমানুসারে সাজালে দাঁড়াবে,
শ্রেণিবিভাগ(Classification) < শ্রেণিবিন্যাস(Taxonomy) < শ্রেণিবদ্ধতা(Systematic)
নেস্টেড হায়ারার্কি
জীবজগৎকে বিভিন্নভাবে শ্রেণীবিন্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মারগুলিস, লিনিয়াস, থিওফ্রাস্টাস অ্যারিস্টটল প্রমুখ তাদের মতো করে জীবজগতের মধ্যে আলাদা আলাদা দল বা বিভাগ তৈরি করেছেন। তবে শ্রেণীবিন্যাস পদসোপান (Taxonomic Hierarchy) এর সবথেকে বৈচিত্রময়, স্পষ্ট ও বিস্তারিত হায়ারার্কি হলো নেস্টেড হায়ারার্কি।
ছোট থেকে বড় সবাই এ সম্পর্কে যদিও জানে, তবে এর গভীরতা নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। ক্যারোলাস লিনিয়াস “Systema Nature” গ্রন্থে এই পদসোপানের একটা সাধারণ ধারণা দেন। তাঁর ধারণায় শ্রেণীবিন্যাসের মাত্র পাঁচটি স্তর ছিলঃ শ্রেণী, বর্গ, গণ, প্রজাতি এবং প্রকরণ। পরবর্তীতে এ ধারায় নতুনত্ব দেখা যায়। বর্গ এবং গণের মাঝখানে নতুন একটি স্তর গোত্র যুক্ত হয়। আর শ্রেণীর উপরে পর্ব এবং তার উপরে জগৎ যুক্ত হয়। কিন্তু স্বতন্ত্র ও বিবর্তনিক একক হিসাবে মর্যাদা না পাওয়ায় প্রকারণের বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে! এখনো পর্যন্ত এই সাতটি স্তর অভিন্ন ও বহাল রয়েছে। তাহলে চলুন সিঁড়ি দিয়ে সাত ট্যাক্সনের (শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিটি তলাকে ট্যাক্সন বলে) বিল্ডিংয়ে পৌঁছে যাই।
প্রথম ট্যাক্সনে উঠে “প্রজাতি” নামটি দেখতে পেলাম। এটি শ্রেণিবিন্যাসের মৌলিক একক। একই প্রজাতির জীবেরা সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ এবং নিজেদের মধ্যে মিলনে উর্বর জীব উৎপাদনে সক্ষম। শুধু তা-ই নয়, এরা নিজেদের মধ্যে জিন বিনিময় ও অভিন্ন জিন ভাণ্ডার থেকে জিনের মুক্ত প্রবাহ অব্যহত রাখে। মজার বিষয় হলো, একমাত্র প্রজাতিরই নিজস্ব সত্ত্বা বিদ্যমান। প্রজাতিকে আমরা প্রয়োজনানুসারে উপপ্রজাতি, প্রকরণ ইত্যাদি অংশে ভাগ করতে পারি।
দ্বিতীয় ট্যাক্সনে রয়েছে গণ (Genus)। পরস্পর কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের, সম্পর্কযুক্ত একাধিক প্রজাতির সমন্বয়ে গণ গঠিত হয়। অর্থাৎ একটি গণের মধ্যে জাতিজনি ভিত্তিক (যে পদ্ধতিতে জীবকে উৎপত্তি ও বিবর্তনের ধারায় আদি থেকে উন্নত ক্রমে সাজিয়ে বিন্যস্ত করা হয়, তাকে জাতিজনি শ্রেণিবিন্যাস বলে) একাধিক প্রজাতি অন্তর্ভুক্ত থাকে। একটি গণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত প্রজাতিগুলো একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত। বাস্তুসংস্থানিক দিক দিয়ে এরা সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং একই প্রণালীতে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ও খাপ খাওয়াতে সক্ষম। গণকে প্রয়োজনে উপগণ, সেকশন, সিরিজ ইত্যাদি বিভক্ত করা হয়।
পরবর্তী ট্যাক্সনে রয়েছে গোত্র (Family), যেটার উল্লেখ লিনিয়াসের পদসোপানে ছিল না। মূলত এক বা একাধিক পরস্পর সম্পর্কযুক্ত গণের সমন্বয়ে একটি গোত্র গঠিত হয়। এই গণসমূহ একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত। একটি গোত্রের পরিধি অনেক বিস্তৃত, এমনকি বিশ্বব্যাপীও হতে পারে। তবে এদেরকে বাস্তুসংস্থানিক ও অভিযোজনমূলক গুণাবলি দ্বারা সহজেই নির্ধারণ করা বা চেনা সম্ভব। শ্রেণিবিন্যাসের এই ট্যাক্সনকে উপগোত্রেও ভাগ করা যায়। সাধারণত কোনো একটি গোত্রের নামের শেষাংশে aceae থাকে। যেমনঃ কাঁঠালের গোত্র Moraceae।
চতুর্থ ট্যাক্সনে রয়েছে বর্গ (গণিতের চার বাহুওয়ালা বর্গের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই)। এক বা একাধিক গোত্রের সমন্বয়ে যে ট্যাক্সনটি গঠিত, তাকে আমরা বর্গ বা Order বলি। কালের বিবর্তনে ট্যাক্সোনমির অব্যহত ধারাবাহিক উন্নয়নে বর্গের পরিধি বিস্তৃত হওয়া বঞ্চনীয়। কেননা বর্গের পরিধি বড় হলে বহুসংখ্যক গোত্রকে একই দলে আনা সম্ভব হবে (তবে সেক্ষেত্রে মানতে হবে বেশ কিছু জটিল নিয়ম)। একটি বর্গের শেষাংশে সাধারণত ales থাকে। যেমনঃ জবার বর্গ Rosales। তবে কখনো কখনো ates ও থাকতে পারে। যেমনঃ মানুষের বর্গ Primates।
পরবর্তী ট্যাক্সনে উঠে শ্রেণিকে (Class) দেখা যাচ্ছে। আমরা জানি যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কতিপয় বর্গের সমন্বয়ে সৃষ্ট স্তরকে শ্রেণি বলে। সাধারণত বিবর্তনের ধারা, অভিযোজনের গতি-প্রকৃ্তি, অঙ্গসংস্থানিক ও বাস্তুসংস্থানিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি দ্বারা দু’টি শ্রেণিকে আলাদাভাবে চেনা বা শনাক্ত করা যায়। অনেক বিজ্ঞানীর মতে শ্রেণির পরিধি অনেক বিস্তৃত হওয়া উচিৎ। অবশ্য এটা নিয়ে অনেক মতপার্থক্য আছে, তবে বিষয়টা যৌক্তিক এবং জরুরি। একটি শ্রেণিকে আমরা প্রয়োজনে উপশ্রেণি ও অধিবর্গে বিভক্ত করতে পারি।
পরবর্তী ট্যাক্সনে রয়েছে পর্ব (Phylum) বা বিভাগ (Division)। আমরা এই স্তরকে প্রাণিদের ক্ষেত্রে পর্ব আর উদ্ভিদের ক্ষেত্রে বিভাগ বলি। কতিপয় সাদৃশ্যপূর্ণ শ্রেণি একত্রে এই ট্যাক্সনটি তৈরি করে। কয়েকটি বড় বড় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একটি পর্ব বা বিভাগ নির্ধারিত হয়। আবিষ্কৃত জীবের সংখ্যা দিন দিন বৃ্দ্ধি পাওয়ায় এই ট্যাক্সনের সংখ্যাও বাড়ছে। কোষ, টিস্যু, দেহ গঠন ইত্যাদি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে প্রথমদিকে জীবজগতের ১০টি পর্ব তৈরি হলেও আজ তা ৪০ ছাড়িয়েছে। প্রয়োজনানুসারে পর্ব বা বিভাগকে উপপর্ব বা উপবিভাগে বিভক্ত করা হয়।
ইয়াহু! আমরা এখন ট্যাক্সোনমির সর্বোচ্চ ট্যাক্সন জগতে (Kingdom) উঠে পড়েছি। এটাই সবথেকে বড় স্তর। কয়েকটি পর্ব বা বিভাগ একত্রে একটি জগৎ বা Kingdom গঠন করে। যেমনঃ মসবর্গীয়, ফানবর্গীয়, নগ্নবীজী এবং আবৃতবীজী-এই চারটি বিভাগের সমন্বয়ে প্লান্টি (Plantae) রাজ্য গঠিত। আমরা জানি, জীবদের ৫টি জগৎ: ব্যাকটেরিয়া বা মনেরা, প্রোটিস্টা বা প্রোটিকটিস্টা, ফানজাই, প্লান্টি এবন অ্যানিমেলিয়া। এসব নিয়ে না হয় অন্য কোনো দিন কথা হবে! যাহোক, এই স্তরে দাঁড়িয়ে একটি জগতের অন্তর্ভুক্ত সকল জীবদের একসাথে নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জীব আবিষ্কারের ফলে প্রতিটি রাজ্য বা Kingdom এর পরিধি ধীরে ধীরে বাড়ছে।
বিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে সাথে জীবের পরিচিতি বৃ্দ্ধি পাওয়ায় শ্রেণিবিন্যাস পদসোপানের মূল ৭টি স্তরের সাথে supra (অধি), sub (উপ), infra (ইনফ্রা) ইত্যাদি যোগ করে কতগুলো নতুন স্তর সংযোজিত হয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে Simpson ২১টিকে এবং Mayr ১৮টিকে স্বীকৃ্তি দিয়েছেন।
শ্রেণিবিন্যাসের ইতিহাস ও উত্থান
প্রাচীন গ্রিক যুগের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য না পাওয়া গেলেও এই সময়টাকে ট্যাক্সোনমির উৎপত্তিকাল বলা যেতে পারে। অ্যারিস্টটলকে অনেকে শ্রেণিবিন্যাসের আদি জনক বলে থাকেন। তিনিই সর্বরপ্রথম প্রাণীকুলের উপর বিস্তৃত গবেষণা করেন। তিনি Historia Animalium বইয়ে প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য, স্বভাব, ভ্রূনতত্ত্ব, বাস্তুসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করে একটি সুবিন্যস্ত ধারা তৈরি করেছিলেন। অ্যারিস্টটল পতঙ্গের Diptera ও Coleoptera বর্গের নামকরণ করেছিলেন, যা আজও অপরিবর্তিত।
এছাড়াও থিওফ্রাস্টাস সমগ্র উদ্ভিদজগৎকে বৃক্ষ, গুল্ম, উপগুল্ম ও বীরুৎ এই চারভাগে শ্রেণিবিন্যস্ত করেছিলেন। তিনি প্রায় ৪৫০ প্রকার উদ্ভিদের নামকরণ করে রেখেছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে সুশ্রতের কথা বলা যায়, যার রচনায় প্রাণিজগতের শ্রেণিবিন্যাস পরিলক্ষিত হয়।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে জন রে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপর গুরত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তিনি উদ্ভিদের আকার, গঠন, প্রকৃ্তি, পাতা, ফুল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে তাদেরকে বিন্যস্ত করেছিলেন। এই বিজ্ঞানীই সর্বপ্রথম গণ ও প্রজাতির মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করেন।
শ্রেণিবিন্যাসের পরবর্তী ইতিহাসটা ছিল আধুনিক ট্যাক্সোনমির ভিত্তিযুগ। ক্যারোলাস লিনিয়াসকে ঐ সময়ের শ্রেষ্ঠ শ্রেণিবিন্যাসবিদ মনে করা হয়। তিনি বহু জীবের নামকরণ করেছিলেন। তার নামকরণ পদ্ধতি ছিল দ্বিপদী। যেমনঃ আমের দ্বিপদ না Mangifera indica । লিনিয়াস জননাঙ্গের উপর ভিত্তি করে প্রাণিজগৎকে ২৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই চিকিৎসাবিদ ও তার সহযোগীরা ট্যাক্সোনমির পাতায় অনেক কিছু যোগ করেন, যার উপর ভিত্তি করেই আজকের ট্যাক্সোনমি গড়ে উঠেছে। লিনিয়াসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই দু’টি হলো Species plantarum ও Systema naturae।
এরপরের যুগকে অনেকে “প্রয়োগসিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির যুগ” বলে থাকেন। ইতিহাসের এই পর্যায়ে জে.বি.ল্যামার্ক, মাইকেল এডানসন, কুভি প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। এসময়ের মূল সফলতাগুলো হলো জাতিজনি ধারণার আবির্ভাব ঘটা, শ্রেণিবিন্যাস ও শনাক্তকরণে একাধিক বৈশিষ্ট্যের ব্যবহার ইত্যাদি। যদিও ল্যামার্কের বিবর্তনবাদ পরিত্যক্ত, তবে এই মতবাদটি সরল থেকে জটিল দিকে প্রাণীদের বিন্যস্ত করার চেষ্টা করেছিল, যা ট্যাক্সোনমিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ট্যাক্সোনমি সমৃদ্ধ হতে থাকে এবং তখনই ডারউইনের তত্ত্ব সামনে আসে। ইতিহাসের এই সময়টি মূলত ডারউইন প্রদত্ত প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদের জন্য বিখ্যাত। তার মতে জীবের উৎপত্তি ও সরল ট্যাক্সন থেকে জটিল ট্যাক্সনের ধারাবাহিক বিকাশের উপর নির্ভর করে অভিব্যক্তি ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসের আবির্ভাব ঘটে। তিনি মনে করেছিলেন, ভিন্ন ভিন্ন ট্যাক্সনের মধ্যে বিভেদন শাখা বিস্তারকারী প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি স্থাপন করা জরুরি। এ যুগে শ্রেণিবিন্যাসের জাতিজনি ধারা সুসংগঠিত ভাবে প্রকাশিত হওয়া দু’টি ভিন্ন ধরণের (অবরোহী ও আরোহী) ধাপগুলোর মধ্যে যোগসূত্রের স্পষ্টতা পরিলক্ষিত হয়। ঐ সময়ে মিসিং লিংক ও আদি পূর্বপুরুষ অনুসন্ধানে বহুমুখী তথ্যের উদ্ভব ঘটে।
এরপরে আসে “জনগোষ্ঠী ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতির যুগ”। ঐ সময়টি আধুনিক চিন্তাধারার সূত্রপাত ঘটাতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এই যুগের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো প্রাণীর নামতত্ত্বের নিয়মাবলি প্রস্তাবিত হওয়া, ICZN গঠন, একটি বা গুটি কয়েক সদস্যের উপর ভিত্তি করে প্রজাতির বর্ণনা দিতে বিজ্ঞানীদের অনিচ্ছা প্রকাশ ইত্যাদি। মূলত ঐ সময়টাতেই প্রজাতি সম্পর্কিত টাইপিফিকেশন ধারণা পরিত্যক্ত হয়ে এর পরিবর্তে বহুরূপীয় ধারণা স্বীকৃ্তি পায়।
ট্যাক্সোনমির ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় হলো “আধুনিক চিন্তাধারার যুগ”। এসময়ে হাক্সলে, মায়ার, সিম্পসন প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ শ্রেণিবিন্যাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তারা যে অবদান রেখেছিলেন, তাতে শ্রেণিবিন্যাসের পুনর্গঠন ও পুনর্মূল্যায়ন সম্পাদিত হয়। এ যুগে এসে বিজ্ঞানীরা পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যাবলির পর্যবেক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন। এছাড়াও ঐ সময়ে ট্যাক্সোনমিতে বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকিউলার বায়োলজির আলোচনা বিশেষভাবে প্রবেশ করে। অঙ্গসংস্থান, বাস্তুবিদ্যা, প্রাণরসায়ন, কোষতত্ত্ব, আধুনিক বিবর্তনবাদ, বংশগতি, আণবিক জীববিজ্ঞান ইত্যাদি শাখার তথ্যের ভিত্তিতে নিকটতম জীবগোষ্ঠীর সাথে তুলনাপূর্বক শনাক্তকরণ ও নামকরণ প্রক্তিয়াই হলো আধুনিক শ্রেণিবিন্যাসের পদ্ধতি বা ধারার মূল বৈশিষ্ট্য।
এভাবেই শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি দিনে দিনে সমৃদ্ধ হচ্ছে, যার ধারা আজও অব্যহত আছে। এর ফলে ট্যাক্সোনমি জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
উপসংহার
শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে আলোচনা করার মতো আরও অনেক কিছু ছিল। যেমনঃ শ্রেণিবিন্যাসের ধরণ, ICBN, ICZN, অগ্রাধিকার আইন, ট্যাক্সোনমিক প্রকাশনা, শ্রেণিবিন্যাস তাত্ত্বিক সংগ্রহ ইত্যাদি। কিন্তু, এতোকিছু যদি একটা প্রবন্ধের মধ্যে নিয়ে আসি, তবে পাঠক হিসেবে আপনি পুরোটা পড়ার স্পৃহা হারিয়ে ফেলতে পারেন। আগেই বলেছি, ট্যাক্সোনমির পরিধি ব্যাপক! তাই আলোচনাগুলো সংক্ষিপ্ত করেছি এবং কিছু বিষয় বাদ রেখেছি। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আমি মূলত ট্যাক্সোনমি বা শ্রেণিবিন্যাসের ব্যাপারে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
তথ্যসূত্র
৩. Taxon: Definition & Examples
Leave a Reply