২০০৩ সালে গবেষকরা মানব জিনোমের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স আবিস্কারের ঘোষণা আসে। কিন্তু, ঐখানে প্রায় ৮% অসম্পূর্ণতা ছিল। এই ৮% এর মধ্যে আছে সেন্ট্রোমিয়ার, বার বার পুনরাবৃত্ত হওয়া ডিএনএ ও হেটারোক্রোমাটিন স্ট্রাকচার। ঐখানে অনেকগুলো ডিএনএ টুকরোর পুনরাবৃত্তির ফলে সেগুলোকে অন্যান্য অংশের সাথে মেলানো যাচ্ছিল না। কিন্তু, মার্চের শেষে এসে বিজ্ঞানীরা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে শতভাগ সম্পূর্ণ জিনোমের সিকোয়েন্স আবিষ্কারের ঘোষণা করেছেন। নতুন “লং রিড” সিকোয়েন্সিং কৌশল ডিএনএর বড় অংশগুলিকে ডিকোড করতে পেরেছে।
জিনোম সিকোয়েন্স আসলে কী? সোজা বাংলায় এক কথায় বলতে গেলে জিনোম হলো কোষের মধ্যে থাকা সকল বংশগতীয় উপাদানের সমষ্টি। ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য বলছে যে কোনো জীবের সামগ্রিক অবস্থার ব্যাপারে জানতে হলে তার জিন সম্পর্কে জানতে হবে। আর এই জিনের ব্যাপারে জানার জন্য দরকার জিনোম সিকোয়েন্সিং। জীবের কোষে ডিএনএ অণুর বেসগুলো কীভাবে সজ্জিত আছে, সেই অনুক্রমকে জিনোম সিকোয়েন্স বা জিনোম অনুক্রম বলে। আর এই অনুক্রম নির্ণয় করার পদ্ধতিকে জিনোম সিকোয়েন্সিং বলে।
ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া, ধান-পাট, অমুক-তমুক বহু জীবের জিনোমের পুরো সিকোয়েন্স খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু, মানুষের জিনোম সিকোয়েন্সের পুরোটা উদ্ধার করে ফেলা-এবারই প্রথম। Telomere-to-Telomere (T2T) কনসোর্টিয়ামের বিজ্ঞানীরা এখন মানব জিনোমের প্রথম সত্যিকারের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্সের রিপোর্ট করেছেন। প্রায় দুই দশক পর হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট সম্পূর্ণ মানব জিনোম সিকোয়েন্স তৈরি করেছে। এ ব্যাপারে বিবৃতি দিয়েছে ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইন্সটিটিউট। এই অর্গানাইজেশনের পরিচালক এরিক গ্রিন বলেন, “সম্পূর্ণ মানব জিনোম সিকোয়েন্স পাওয়াটা একটি অবিশ্বাস্য বৈজ্ঞানিক সাফল্য, যা মানুষের ডিএনএ ব্লুপ্রিন্টের সামগ্রিক চিত্র প্রদান করবে।“
কিন্তু, প্রশ্ন হলো, আমাদের জিনোম সিকোয়েন্স বের করে ফেলা হলো। এতে আমাদের লাভ কোথায়? নাকি শুধু অর্থের অপচয়? প্রশ্নের উত্তর আমি এভাবে শুরু করব যে লাভ নেই কোথায়? এই আবিষ্কারের কল্যাণে জীবন ও সুস্থতার রহস্যের ব্যাপারে জানা যাবে। একটু বুঝিয়ে বলা দরকার।
জিনোম সিকোয়েন্স থেকে কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য দায়ী জিনের ব্যাপারে জানা যায়। এ থেকে আমরা প্রোটিনের গঠন সম্পর্কে ধারণা পাবো। প্রোটিন হলো জীবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই প্রোটিনের ব্যাপারে কিছু জানলে সেটা দিয়ে জীবের বিভিন্ন ফাংশনের রহস্য বের করে ফেলা সম্ভব।
যাহোক, আবার জিনের কথায় ফিরে আসি। এর আগে জিনোম সিকোয়েন্স থেকে মানুষের ইনসুলিন উৎপাদনকারী জিন সম্পর্কে জানার কারণে Escherichia coli এবং কুসুম ফুলে সেই জিন প্রবেশ করিয়ে আমরা দেহের বাইরে ইনসুলিন তৈরি করতে পেরেছি। এরপর থেকে ইনসুলিনের ঘাটতি পূরণ করা সহজ হয়ে গিয়েছে।
মানব জিনোম সিকোয়েন্স থেকে ক্রোমোজোমে থাকা জিন গুলোর অবস্থান জানা যায়। এ থেকে সুস্থ ও অসুস্থ জিনের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ থেকে ঐ অসুস্থ জিন শনাক্ত করা যায় আর যখনি এটা সম্ভব হবে, তখনি রোগ প্রতিকারের চাবি হাতে পাওয়া যাবে। এরপর যেটা করতে পারব, সেটা হলো ক্রিসপার প্রযুক্তি দিয়ে ঐ জিনকে বদলে দিতে পারব। এতে করে সহজে রোগের প্রতিকার করা সম্ভব হবে। এমনকি কোনো রোগের মিউটেশন মেন্ডেলীয় প্রচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে (রোগ সৃষ্টি করতে দুইটি অ্যালিলে মিউটেশন থাকতে হবে) এমন জিনকে আমরা রোগ সৃষ্টি করার আগেই ধরে ফেলতে পারব। অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানব জিনোম সিকোয়েন্স এখন জিনোম সম্পাদনাকে পূর্ণতা দান করবে।
শুধু কি তাই? এখন এই জিনোম সিকোয়েন্সের কল্যাণে জানতে পারব যে আপনার-আমার দেহে কোন জিন কী করবে। যদি কোন জিন উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে অথবা মিউটেশনের শিকার হয়, সেটাও দ্রুত জানা যাবে। এমনকি ঐ জিনের কান ধরে সোজা পথে আনা সম্ভব হবে। এতে করে ক্যান্সার নির্মূল সহজ হবে।
তবে একটা বিতর্কের জায়গাও আছে। সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স যেহেতু ক্রিসপার প্রযুক্তিকে সমৃদ্ধ করবে, তাই ক্রিসপার প্রযুক্তি কোন দিকে যাবে, সেটাও নৈতিকতা ভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
সব মিলিয়ে বলতে গেলে, আমরা এখন নিজেদেরকে চিনতে পারব, নিজেদের ব্যাপারে আরও কিছু জানতে পারব। ধারণা করা যায়, আগামী দশকের মধ্যেই সম্পূর্ণ মানব জিনোম সিকোয়েন্স চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বদলে দিবে। হয়ত বা এই জিনোম সিকোয়েন্সের ব্যাপারে জানতে পারাটাই আমাদেরকে সুপার হিরো বানিয়ে তুলবে। সেই লক্ষ্যেই সামনের দিনগুলোতে পরিচালিত হতে চলেছে বহুমুখী গবেষণা। বায়োটেকনোলজির জগতে আমাদের জিনোম সিকোয়েন্স নতুন একটি অধ্যায় হবে।
তথ্যসূত্র ও সহায়ক বইঃ
১. Scientists decode entire human genome at last
২. The complete sequence of a human genome || Science
৩. Closing in on a complete human genome || Nature
৪. জেনেটিক্সঃ বংশগতিবিদ্যার সহজ পাঠ-আরাফাত রহমান
Leave a Reply