কেমন হয় যদি আমাদের হার্টবিটের মতোই এই পৃথিবীরও নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির তরঙ্গ উৎপন্ন হয়? আমাদের হার্টবিট যেরকম হৃৎপিন্ডে ধুক ধুক করে, তেমনি পৃথিবীর হার্টবিট আয়নোস্ফিয়ারে উৎপন্ন হয়। পাঠকেরা হয়ত বা ভাবছেন যে আমি মনে হয় গ্রিক পুরাণের গল্প করেছি। তবে এটা যে পিওর সায়েন্স, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আপনাদেরও থাকবে না যদি এই প্রবন্ধ পুরোটা পড়েন।
পৃথিবীর হার্টবিট পদার্থবিজ্ঞানের সংবিধানে শুম্যান রেজোনেন্স (Schumann resonances) নামে পরিচিত। পদার্থবিজ্ঞানী উইনফ্রাইড অটো শুম্যানের নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। পৃথিবীর পৃষ্ঠ এবং আয়নোস্ফিয়ারের মধ্যবর্তী স্থানটি একটি বদ্ধ তরঙ্গ নির্দেশক হিসাবে কাজ করে বলে শুম্যান রেজোনেন্স (রেজোনেন্স মানে কিন্তু অনুনাদ) ঘটে। এই ফ্রিকোয়েন্সিগুলো 7.83 Hz থেকে শুরু হয়। পৃথিবীর আবহাওয়া, বৈদ্যুতিক পরিবেশ, বায়ুমন্ডল ইত্যাদির বিশ্লেষণমূলক তথ্য জানতে এই অনুনাদটি বিশেষভাবে সহযোগিতা করে।
যেকোনো মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রায় ২০০০টি বজ্রঝড় বয়ে যায়, যা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৫০টি বিদ্যুতের ঝলকানি তৈরি করে। প্রতিটি বজ্রপাত তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ (Electromagnetic Wave) তৈরি করে। পৃথিবীর পৃষ্ঠ এবং প্রায় 60 মাইল উপরে একটি সীমানার মধ্যে পৃথিবীকে বৃত্তাকারে পরিবেষ্টন করতে শুরু করে। কিছু তরঙ্গ (যদি তাদের ঠিক সঠিক তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকে) একত্রিত হয়, শক্তি বৃদ্ধি করে এবং একটি পুনরাবৃত্তিকারী বায়ুমণ্ডলীয় হৃদস্পন্দন তৈরি করে। এটিই আমাদের সেই অনুনাদ মামা।
আমরা সাধারণত শুম্যান রেজোনেন্স শুনতে পারব না, কিন্তু এর কম্পন অনুভব করতে পারব। মজার বিষয় হলো 7.83 Hz মানুষের মস্তিষ্কের গড় আলফা ফ্রিকোয়েন্সি। মানে শুম্যান রেজোনেন্স আর ব্রেইন ওয়েভের মাঝে একটা বিশাল মিল রয়েছে। যাহোক, এটি অনুমান করা হয়েছে যে বহির্জাগতিক বজ্রপাত তাদের শুম্যান রেজোনেন্সের মাধ্যমে শনাক্ত করা যেতে পারে। আরেকটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, স্বল্পমেয়াদী ভূমিকম্পের পূর্বাভাসের সাথে শুম্যান রেজোনেন্সের একটা সম্পর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সাথেও শুম্যান রেজোনেন্সের যোগসূত্র থাকতে পারে। ভূ-ভৌতিক জরিপ থেকে জানা যায় যে শুম্যান রেজোন্যান্সগুলি অফশোর হাইড্রোকার্বন ডিপোজিট শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়।
মজার বিষয় হলো, জানা গেছে যে পৃথিবীর এই হার্টবিট মানুষকে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে। কারও মতে, সম্মোহন এবং গ্রোথ হরমোনের সাথে শুম্যান রেজোনেন্সের সম্পর্ক রয়েছে। তবে এটার পক্ষে বিজ্ঞানীরা শক্ত প্রমাণ খুঁজছে। গবেষণা বলছে যে রক্তচাপ, স্নায়বিক রোগ, প্রজনন, ক্যান্সার, কার্ডিয়াক চক্র ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলোকে এই অনুনাদ প্রভাবিত করে। (পড়ুনঃ পৃথিবীর হার্টবিট কি শরীরের উপর প্রভাব ফেলে?)
শুম্যান রেজোনেন্স একদিকে যেমন পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রভাবক, তেমনি এটি বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সাথেও জড়িয়ে আছে। এই ফ্রিকোয়েন্সির ব্যাপারে বেশ কিছু হাইপোথিসিস রয়েছে, যেগুলোকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে রূপ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন গবেষণা হচ্ছে। হয়ত বা নতুন গবেষণাগুলোর সাথে সাথে আমরা মানবজাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ কোনো সূত্র পেয়ে যাবো।
তথ্যসূত্রঃ
১. Schumann resonances|| Wikipedia
২. Schumann Resonance – NASA
৩. Is the Earth’s “heartbeat” of 7.83 Hz influencing human behavior?-Big Think
Leave a Reply