অ্যান্টিবায়োটিক কি?
অ্যান্টিবায়োটিক কি?
কয়েকধরনের জৈব রসায়নিক ঔষধ, যা অনুজীবদের (ব্যাক্টেরিয়া) নস্ট করে বা বংশ বিস্তার রোধ করে। সাধারনত একেক অ্যান্টিবায়োটিক একেক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অনুজীবদের বিরুদ্ধে কাজ করে।
ব্যাকটেরিয়া নিজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারেনা বিধায় নিজেদের অঞ্চল থেকেই তাদের খাদ্য সংগ্রহ করার কারনে তারা একই অঞ্চলে থাকা অন্য ব্যাকটেরিয়া গুলোর সাথে প্রতিযোগীতা করে। এক ব্যাকটেরিয়া আরেক ব্যাকটেরিয়া কে মারার জন্য এন্টিবায়োটিক তৈরী করে। এই অ্যান্টিবায়োটিকই আমরা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করি।
কোন কোন ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার করা হয়?
অ্যান্টিবায়োটিক শুধুমাত্র কিছু ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসা করে, যেমন স্ট্রেপ থ্রোট, মূত্রনালীর সংক্রমণ এবং ই.- কোলাই।কিছু ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের প্রয়োজন নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক সাইনাস সংক্রমণ বা কিছু কানের সংক্রমণের জন্য আপনার তাদের প্রয়োজন নাও হতে পারে। প্রয়োজন না হলে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা আপনাকে সাহায্য করবে না এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। আপনি অসুস্থ হলে আপনার হেলথকেয়ার প্রফেশনাল আপনার জন্য সর্বোত্তম চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আপনার সরবরাহকারীকে আপনার জন্য একটি অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিতে বলবেন না কখনই।
অ্যান্টিবায়োটিক কি ভাইরাল অর্থাৎ ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা করে?
অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাল সংক্রমণে কাজ করে না। উদাহরণস্বরূপ, আপনার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত নয়:
- সর্দি এবং সর্দি, এমনকি যদি শ্লেষ্মা ঘন, হলুদ বা সবুজ হয়
- বেশিরভাগ গলা ব্যথা (স্ট্রেপ থ্রোট বাদে)
- ফ্লু
- ব্রঙ্কাইটিসের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে
অনেকে নামেমাত্র জ্বর হলেই খুব শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা শুরু করে, যা কোনভাবেই উচিত নয় কেননা জ্বর বিভিন্ন কারনে হতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি?
অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছোট থেকে খুব গুরুতর পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিছু সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত:
- ফুসকুড়ি
- বমি বমি ভাব
- ডায়রিয়া
- ইস্টের সংক্রমণ
আরো গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে পারে:
- সি. ডিফ ইনফেকশন, যা ডায়রিয়া ঘটায় যা মারাত্মক কোলনের ক্ষতি এবং কখনও কখনও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে
- মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী এলার্জি প্রতিক্রিয়া
- অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ৭২টি দেশের নদীর নমুনা গবেষণা করে দেখেছে যে নদীর পানিগুলো ৬৫ শতাংশ এন্টিবায়োটিক দ্বারা দূষিত। আর এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবথেকে শোচনীয় বলে ধারণা করা হয়েছে! এই পানি ব্যবহারের মাধ্যমে বা এই পানির মাছ থেকে আমাদের দেহে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শরীরে প্রবেশ করছে এবং আমাদের দেহে গঠিত হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক বিরোধী প্রতিরোধ। গবেষনায় ধারণা করা হয়েছে ২০৫০ সালে ১০ মিলিয়ন মানুষ এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স এর কারনে মারা যাবে যা ক্যান্সার কিংবা এইডসসহ অন্য যেকোনও রোগের তুলনায় অনেক বেশি (de Kraker, 2016; Stewardson, 2016; Harbart, 2016)। এছাড়াও ২০১৯ সালে ১২ লক্ষ্য ৭০ হাজার মানুষ মারা গেছে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স এর জন্য। তাই এই বিষয়ে জানা ও মানা বেশ জরুরি।প্রথমত………
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কি?
অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই ক্ষেত্রে ঔষধ খেয়েও ভালো ফল পাওয়া যায় না, কারন জীবাণুর বিপক্ষে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করতে পারেনা।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কিভাবে হয়?
প্রয়োজনের অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনে অথবা অতিরিক্ত এ্যান্টিবায়োটিক সেবনে শরীরের ক্ষতিকর জীবাণু তার নিজের জিনেটিক কোডে এমন পরিবর্তন আনে যে সেই এন্টিবায়োটিক তার তেমন কোন ক্ষতি করতে পারেনা।
কারণসমূহঃ
- মাত্রাতিরুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা ।
- রোগীদের নির্দিষ্ট চিকিৎসাব্যবস্থা পরিপূর্ণরুপে শেষ না করা ।
- হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো তে জীবাণু নিয়ন্ত্রণের অব্যবস্থাপনা ।
- স্বাস্থ্যবিধির অভাব ও ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা ।
- গৃহপালিত পশুপাখি পালনে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার
- নির্দিষ্ট রোগের জন্য সঠিক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা
- নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের অভাব ।
আবার আমরা যা খাই, সবজি, ফল বা মাছ মাংস এর মধ্যে থেকে যাওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে থাকে।যেমন-
- মুরগীর মাংস
- গরু বা খাসীর মাংস
- দুধ এবং দুগ্ধ জাতীয় খাবার
- মাছেও হরমোন ব্যবহার করা হয়, সেখানেও এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয় রোগ প্রতিরোধী করার জন্য
- শাক-সবজি যদিও এতে সরাসরি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়না। তবে কীটনাশক দেওয়া হয়।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়েছে- এসব এর মূল কারণ ফার্মাসিস্ট বিহীন অবৈধ ভাবে ফার্মেসি ব্যবসা, লাইসেন্স বিহীন ওষুধের ব্যবসা।অত্যন্ত দুঃখজনক গ্রামের চায়ের দোকানেও ঔষধের ব্যবসা হয় এখন- যেখানে ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট এর পরামর্শ ব্যতিত ঔষধ সেবন করছেন সাধারণ রোগীরা।
ওষুধের অপব্যবহার কারণে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স – এভাবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে ভবিষ্যতে রোগ মুক্তির জন্য ঔষধ পাওয়া টা দুঃসাধ্য।
এছাড়া আপনার অযোক্তিক ভাবে দ্রুত ব্যথ্যা মুক্ত হতে- রেগুলার ব্যথানাশক এর মতো ভয়ংকর ঔষধ সেবন করেছেন- তা ভবিষ্যতে আপনার কিডনি নষ্ট/ বিকল করে দিবে।
সম্পন্ন অবৈধ ভাবে বিনা প্রেসক্রিপসনে অহরহ চলছে ঘুমের ওষুধ বিক্রি- অপ্রয়োজনে নিয়মিত ঘুমের ওষুধ সেবন এটা নেশা হয়ে যায়। ঘুমের ওষুধ একটা ড্রাগস – অনেক অসাধু মাদকদ্রব্যের পরিবর্তে বা ভেজাল মিশ্রিত মাদকদ্রব্যের সাথে ও মৃত্যু ঝুঁকি ঘুমের ওষুধ সেবন করেন। যা ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট ব্যতিত প্রেসক্রিপশন ছাড়া ক্রয় বিক্রয় মাদকদ্রব্য আইনে অপরাধী। ঘুমের ঔষধ অতিমাত্রায় নিয়মিত সুনির্দিষ্ট রোগ ব্যতিত সেবন করলে- মানসিক রোগী হয়ে যায় ও শরীরের CNS /ANS এর কার্যক্রম হারিয়ে ফেলে।
সচেতনতার লক্ষ্যে – ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট ব্যতিত ঔষধ ক্রয় বিক্রয় সেবন বন্ধ করুন।
এই ডাক্তারের ওপর ডাক্তারি ফলাতে গিয়ে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছি, আর তাই এখন নিউমোনিয়া,টিবির মতো রোগ গুলি সারছে তো নাই উল্টে রোগীকে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বই এই অভিশাপের গ্রাসে পড়েছে, কিন্তু সবচাইতে যেটা বেশি চিন্তার তা হল এই রিপোর্টেই ভারতসহ এশিয়ার বাংলাদেশ ,পাকিস্তান,নেপাল ইত্যাদি দেশকে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধের এপিসেন্টার হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
এই প্রবণতা কে থামাতে গেলে কিছু গঠন মূলক ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে যেমন –
- কঠোর আইনের মাধ্যমে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ দেওয়া কে বন্ধ করতে হবে।
- সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এন্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহের মত নিজ নিজ দেশেও এইরকম সচেতনতা অভিযান চালানো।
- চিকিৎসা ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মানুবর্তিতা পালন হচ্ছে কিনা তা গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ চালাতে হবে।
- নিজের এবং নিজের চারপাশের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
- মাঝপথে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে নিজে ডাক্তারি না ফলিয়ে, বরং প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ডাক্তারের পরার্মশ অনুযায়ী কোর্স কমপ্লিট না হওয়া অবদি ওষুধ খেয়ে যান।
- কৃষিক্ষেত্র এবং গৃহপালিত পশুপাখির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে অনাবশ্যক এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
- ওষুধের ব্যবহার হয়ে গেলে যত্রতত্র তার খাপ বা মোড়ক ফেলে দেওয়ার থেকে নিজেদের বিরত রাখা।
মনে রাখবেন ওষুধ যেমন রোগ থেকে মুক্তি দেয়, ঠিক তেমনি ভাবে ভুল , অপ্রয়োজনে, অতিমাত্রায় কিংবা ডোজ শেষ না করে ওষুধ সেবন নিশ্চিত মৃত্যু ঝুঁকি ও মহামারী ও ভয়ানক রোগ ডেকে আনে। ওষুধ কে দয়া করে প্রতিদিনের খাদ্য বস্তু ভাতের মতো খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। ঔষধ সেবন একপ্রকার স্ব -ইচ্ছাই বিষ সেবন করা।
অবৈধভাবে, লাইসেন্স বিহীন, ফার্মাসিস্ট ব্যতিত ওষুধ ক্রয় বিক্রয় আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ইহা রাষ্ট্রদ্রোহ, মানবতাবিরোধী, হত্যা যোগ্য অপরাধ । বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ ২০২২, প্রতিবছরের মতো এবছরও ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ পালন করেছে। সপ্তাহ উপলক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল Preventing Antimicrobial Resistance Together. এরকম প্রতিবছরই অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ পালন করে আসছে সেই ২০১৫ সাল থেকে কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিবর্তন খুবই কম হয়েছে।
তাই আসুন সবাই মিলে নিজে বাঁচি, অন্য কে ও নিজের পরিবার কে বাঁচাতে সহয়তা করি।তাই পরিবর্তনের শুরুটা হউক নিজের কাছে থেকে ।
লিখাটি দেশচিত্র পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
Brooks M (16 November 2015). "Public Confused About Antibiotic Resistance, WHO Says". Medscape Multispeciality
Cars O, Nordberg P. (2005). Antibiotic resistance –The faceless threat. Int J Risk Saf Med; 17: 103-10.
Belongia EA, Naimi TS, Gale CM, Besser RE. (2002). Antibiotic use and upper respiratory infections: a survey of knowledge, attitudes, and experience in Wisconsin and Minnesota. Prev Med ; 34: 346-52
de Kraker MEA, Stewardson AJ, Harbarth S (2016) Will 10 Million People Die a Year due to Antimicrobial Resistance by 2050? PLoS Med 13(11)
Leave a Reply