দেহঘড়ি শব্দটা অনেকের কাছেই অপরিচিত মনে হতে পারে। আমরা হাত ঘড়ি, টেবিল ঘড়ি কিংবা দেয়াল ঘড়ি চিনি। কিন্তু দেহঘড়ি জিনিসটা আবার কি? আমাদের দেহ বাইরের জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলে এই দেহঘড়ি দিয়ে। ঘুম, জেগে উঠা, দেহকোষের ভেতরে ঘটা বিপাক ক্রিয়া এই সবকিছুই দেহঘড়ির নিয়মে চলে। সকালবেলা সূর্যের আলোতে ঘুম ভাঙ্গা আর রাতের বেলায় আঁধার ঘনিয়ে আসলে ঘুমোতে যাওয়া, প্রতিদিন আপনি যে সময়ে আহার গ্রহণ করে অভ্যস্ত সে সময়েই ক্ষিধে লাগা- এসবই কিন্তু দেহঘড়ির আইন ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের প্রত্যেকের শরীরই এক একটা দেহঘড়ি। চব্বিশ ঘণ্টার দিন-রাত্রির চক্রের সাথে তাল মেলাতে আমাদের শারীরবৃত্তীয় অবস্থার ছন্দময় উঠানামা চলতে থাকে। এর পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আলো, আঁধার, তাপমাত্রা।
এমনকি সারাদিন আমরা যা খাই তাও। দেহের শারীরবৃত্তীয় অবস্থার এই ছন্দময় পরিবর্তনকে বলা হয় সার্কাডিয়ান ছন্দ। আমাদের ঘুম, হাঁটাচলা, খাওয়া-দাওয়া, ক্ষুধা লাগা, হরমোন চক্র, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, এবং কোষ এর বিকাশ- এই সব কিছুকেই প্রভাবিত করে সার্কাডিয়ান ছন্দ। ১৯৩৫ সালে দুই জার্মান প্রানিবিদ আলাদা ভাবে ফলের মাছির মধ্যে সার্কাডিয়ান ছন্দের উপস্থিতি আবিষ্কার করেন। তাঁরা হলেন হ্যান্স কালমুস এবং এরউইন বুনিং। ফ্রাঞ্জ হালবার্গ সর্বপ্রথম সার্কাডিয়ান নামটির প্রচলন করেন।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2023/06/download-5.jpg?resize=289%2C412&ssl=1)
বলা যায় আমাদের প্রায় সকল শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াই নিয়ন্ত্রিত হয় সার্কাডিয়ান ছন্দের মাধ্যমে। যেমন ঘুম এর কথাই বলা যাক। ঘুম একটা গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক প্রক্রিয়া। সার্কাডিয়ান ছন্দ কি করে আমাদের ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে? এর পেছনে কাজ করে মেলাটোনিন হরমোন। মগজের পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় এই হরমোন। আলোর উপস্থিতে এই হরমোন নিঃসরণ কমে যায়। আর আঁধারে বেড়ে যায়। মগজে সার্কাডিয়ান ছন্দ পরিচালনার কেন্দ্রস্থল হচ্ছে সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াস। আমাদের আলোক গ্রাহক অঙ্গ (চোখ) থেকে আলো সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াসে পৌঁছায়। সেখান থেকে আলো-আঁধারের সংকেত চলে যায় পিনিয়াল গ্রন্থিতে। এভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয় মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ। এই হরমোন আমাদের ঘুমোতে সাহায্য করে।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2023/06/prothomalo-bangla_2021-11_c57d10e4-f7c7-4379-ac18-0a8e354e5648_your_circadian_rhythm_1_ED.webp?resize=764%2C314&ssl=1)
দেহঘড়ির আইন ঠিকঠাক মতন না চললে ঠিক থাকবে না আপনার স্বাস্থ্য। আপনি কখন ঘুম থেকে উঠছেন, এবং রাত্রিবেলায় কখন ঘুমোতে যাচ্ছেন এমনকি কখন খাওয়া সাড়ছেন- এই সবকিছুই আপনার সঠিক স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত। প্রতিদিনকার এই কাজগুলোয় অনিয়ম করলেই ছন্দপতন ঘটে আমাদের দেহঘড়ির। নতুন গবেষণা বলছে, দেহঘড়ির ছন্দপতনে দেখা দিতে পারে ক্যান্সারসহ আরও নানান রকম রোগ। গবেষণা বলছে, রাত জেগে কাজ করেন যারা তাদের সার্কাডিয়ান ছন্দে ব্যাঘাত ঘটে। ফলত তাদের ক্যান্সারসহ দেখা দিতে পারে অন্যান্য রোগ। এরকম ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার হবার সম্ভাবনাই বেশী। প্রস্টেট ক্যান্সার হবারও সম্ভাবনা আছে। তবে কাজের শিফটিং এর ব্যপ্তিকাল একটা ভিন্নতা তৈরি করে। সাধারণত নার্স’রা রাতের শিফটে কাজ করে থাকেন। যেসব নার্স ত্রিশ বছর ধরে রাত জেগে কাজ করছেন তাদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা, যারা এর চাইতে কম সময় ধরে কাজ করছেন তাদের তুলনায় বেশী। যারা ত্রিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে রাতের শিফটে কাজ করছেন তাদের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা আরো বেশী।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2023/06/549D806A-E822-4209-B996B7890287EB5F_source-2.webp?resize=381%2C324&ssl=1)
তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, সার্কাডিয়ান ছন্দ পরিবর্তনের সাথে যকৃত, ফুসফুস এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সার এরও সম্পর্ক আছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্কাডিয়ান জীববিজ্ঞানী, সেলমা মাসরি বলেন, “আমরা এর পেছনে কারণটা বোঝা শুরু করেছি”। উল্লেখ্য যে, সেলমা মাসরি দেখান কি করে সার্কাডিয়ান ছন্দপতন কিছু জিন এর প্রকাশ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে কোলন ক্যান্সারকে আরো ত্বরান্বিত করে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ক্যান্সার এর সাথে সার্কাডিয়ান ছন্দ জড়িত। আমাদের দেহে শক্তি তৈরি হয় বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সার্কাডিয়ান ছন্দপতন দেহের বিপাক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। শুধু তাই-ই নয়। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও আছে এর বিরুপ প্রভাব। ব্যাঘাত ঘটায় কোষের ডিএনএ মেরামত প্রক্রিয়ায়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কোষ সাধারণত আঠারো থেকে চব্বিশ ঘণ্টায় বিভাজিত হয়। সার্কাডিয়ান ঘড়ি দেহ কোষকে রাতের বেলায় বিভাজিত হবার নির্দেশ দেয়। কেননা দিনের বেলা সূর্যের আলোয় ডিএনএ এর ক্ষতিসাধন হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সার্কাডিয়ান ছন্দপতন হলে কোষ বোঝতে পারে না কখন বিভাজিত হতে হবে। তখন স্বাভাবিকের চাইতে দ্রুত গতিতে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ফলে সৃষ্টি হয় টিউমার।
সার্কাডিয়ান ছন্দপতন যে কেবল শিফট কর্মীদের বেলায়ই হয় এমন না। রাত্রি বেলায় অবিরত ভাবে যাদের ভালো ঘুম হয় না তাদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। সপ্তাহে অন্তত একবার যাদের রাত দশটা থেকে ভোর পাঁচটার ভেতর দুই থেকে তিন ঘণ্টার জন্যে নিদ্রা না আসে তাদের ক্ষেত্রেই সম্ভাবনা বেশী। এরকম নিদ্রাহীনতা হতে পারে জেট ল্যাগ, বেশী রাত অবধি বাইরে অবস্থান করা কিংবা মুঠোফোন এর স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলোর কারণে। এমনকি আমরা কি খাই এবং কখন খাই তারও প্রভাব আছে সারকাডিয়ান ছন্দপতনে। একই ভাবে আছে আলো-আধারির প্রভাবও। সার্কাডিয়ান ছন্দ নিয়ে গবেষণার অগ্রগতি ক্রোনোথেরাপি নামক চিকিৎসা পদ্ধতিকে আরও উপযোগী করে তোলছে। এই চিকিৎসাপদ্ধতিতে রোগীর সার্কাডিয়ান ছন্দকে পুনরায় ঠিক করার চেষ্টা করা হয়।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2023/06/60f1248d5456b12e9106830c_illustration-of-a-clock-in-a-head.jpg?resize=571%2C233&ssl=1)
এই ধরানার থেরাপিতে থাকে পর্যাপ্ত ঘুম, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আলোর ব্যবস্থা, এবং কিছু ক্রোনোবায়োটিক মেডিসিন যেমন মেলাটোনিন প্রভৃতির ব্যবহার। রোগীর সার্কাডিয়ান ছন্দ অনুসারে কেমোথেরাপির প্রয়োগ এর কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়। ইদানিং গবেষকরা রেডিয়েশন থেরাপি প্রয়োগের সময়কাল এর ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন। সার্কাডিয়ান ছন্দ ঠিক রাখে এমন ড্রাগ নিয়েও চলছে অনুসন্ধান।
শিফটে কাজ করার বিষয়টা হয়ত পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করা সম্ভব না। কিন্তু শরীরের উপর এর বাজে প্রভাব কমিয়ে আনার উপায়ও হয়ত আছে। গবেষণা বলে, দেহের তাপমাত্রা সামান্যতম বৃদ্ধি সার্কাডিয়ান ছন্দের ব্যত্যয়ের একটা কারণ হতে পারে। যদি তা সত্য হয়, শিফটকর্মীদের শরীরের তাপমাত্রার মূল্যায়ন করে দেখা যাবে। এতে করে প্রত্যেকের জন্যে একটা ব্যক্তিগত কর্ম সময়সূচী হয়ত তৈরি করে দেয়া সম্ভব।
যারা রাত জেগে কাজ করেন না তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য দৈনন্দিন রুটিনে সামান্য কিছু পরিবর্তন আনাই যথেষ্ট। রাতে ভালো ঘুম হওয়া এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। খাদ্যাভ্যাসও একটা ভূমিকা রাখে এখানে। গবেষকরা, টাইম রেস্ট্রিক্টিং এটিং (time restricted eating-TRE) কিংবা ইন্টারমিটিং ফাস্টিং (intermittent fasting) অনুশীলন নিয়ে গবেষণা করছেন। এই টার্ম গুলো দিয়ে দুইটা ব্যাপার বোঝানো হয়- সকালের নাস্তা এক থেকে দুই ঘণ্টা দেরী করে খাওয়া যতক্ষণ না রক্তের করটিসল লেভেল কমছে এবং সান্ধ্যভোজ বিছানায় শোতে যাবার অন্তত তিন ঘণ্টা আগে সেড়ে ফেলা। অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের উপর করা একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে, TRE তাদের বিপাকীয় স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং তাদের ঘুমও আগের তুলনায় ভালো হচ্ছে। অন্য আরেকটা গবেষণা বলছে, TRE ইঁদুর’দের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা কমায় কিংবা টিউমার সৃষ্টির গতি মন্থন করে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, হয়ত সার্কাডিয়ান ছন্দের প্রতি মনোযোগী হওয়ার মাধ্যমে আমরা নিজেদের দেহকে রক্ষা করতে পারব।
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply