বংশবৃদ্ধির তালে

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

স্কুলে থাকতে জীবের প্রজনন পড়তে গেলেই মাথা নষ্ট হয়ে যেত। কোথায় যেন তাল-গোল পাকিয়ে ফেলতাম। এই তাল যেদিন ধরতে পারলাম, সেদিন থেকেই বায়োলজিতে গোল দেওয়া শুরু করলাম। কিন্তু তালটা ধরেছিলাম কীভাবে? আসলে বংশবৃদ্ধি ও প্রজননের কিছু মজার ও অবাক হওয়ার মতো বিষয় পড়তে গিয়েই ধীরে ধীরে “প্রজনন” ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতে শুরু করে। আমার কাছে মনে হয় “প্রজনন” জিনিসটা জীবজগৎকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। শুধু তা-ই নয় এটা প্রজাতিগত বৈচিত্র্যও সৃষ্টি করেছে, আবার বিজ্ঞানীদের ঘুমও হারাম করেছে।

প্যারামেসিয়াম থেকে শুরু করে স্পাইরোগাইরা পর্যন্ত সকল জীবের মধ্যেই আপন ছন্দে “প্রজনন” সংঘটিত হয়। কখনো ঘটায় বিস্ময়, আবার কখনো ঘটে অঘটন। পার্থেনোজেনেসিসের কথাই বলি। এটাকে কি বিস্ময়কর বলব না? এই পদ্ধতিতে বাবা ছাড়াই সন্তানের জন্ম হয়। হুম, ঠিকই শুনেছেন। এটাই সায়েন্স। মৌমাছি, মিউকর ফার্ণ-এসব জীবদের দেহে নিষেক ছাড়াই ডিম্বাণু থেকে ভ্রুণ সৃষ্টি হতে পারে। এটাই পার্থেনোজেনেসিস। তাই বলে ভেবেন না যে এদের গোষ্ঠীতে এই একটাই প্রজনন পদ্ধতি রয়েছে।

যেসব জীবে পার্থেনোজেনেসিস সংঘটিত হয়, তাদের স্বাভাবিক জনন যৌন প্রকৃতির। এই বিস্ময়কর প্রজননের ফলে উদ্ভিদের সুবিধাজনক মিউট্যান্ট বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটতে পারে। একইভাবে নিষেক ছাড়া অনিষিক্ত শুক্রানু হতে ভ্রুণ সৃষ্টি হতে পারে। একে বলে অ্যান্ড্রোজেনেসিস। Nicotina tabacum নামক উদ্ভিদে এরকম উদ্ভট ঘটনা ঘটে থাকে।

এরপর আসুন, কিছু কৃমিদের কথা বলি (জীববিজ্ঞান শিখতে হলে ঘেন্না করা চলবে না)। Enchytraeus fragmentosus নামক যৌনাঙ্গবিহীন কৃমি বংশবৃদ্ধির জন্য অনেকগুলো টুকরায় বিভক্ত হয়ে যায়। একইভাবে স্টেনোটোমাস (Stenotomus) নামক কৃমিরা ৫-৬টি টুকরায় বিভক্ত হয়। এসব বিভক্ত অপূর্ণাঙ্গ অংশগুলো ক্রমান্বয়ে পূর্ণতা পেয়ে অপত্য কৃমিতে পরিণত হয়। কিছুটা একই রকম ঘটনা ঘটে প্ল্যানারিয়া নামক চ্যাপ্টাকৃমির ক্ষেত্রে। 

ওহ হো, শুরুর দিকে প্যারামেসিয়ামের কথা বলেছিলাম। কিন্তু বেচারাকে বঞ্চিত করেই অন্যদের নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিয়েছি। সাধারণত এরা দ্বিবিভাজন প্রক্রিয়ার বিভাজিত হয়। কিন্তু এদের প্রজননের আরেকটা পদ্ধতি আছে। এক্ষেত্রে দুটো প্যারামেসিয়াম কাছাকাছি আসে, অনেকটা ক্লোজ আপের বিজ্ঞাপনের মতো। দুজনের কোষেই ম্যাক্রোনিউক্লিয়াস ও মাইক্রোনিউক্লিয়াস থাকে। এরপর ম্যাক্রোনিউক্লিয়াস ভেঙে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর মাইক্রোনিউক্লিয়াসের বিনিময় ঘটে; মানে এরটা ও নেয়, ওরটা এ নেয়।

এই আদান-প্রদান শেষ হলে দুজন দুজনের কাছ থেকে মুখ ফিরায়ে নেয়। এরপর মাইক্রোনিউক্লিয়াস বিভাজিত হতে থাকে এবং সেই তালে তাল দেয় প্যারামেসিয়াম নিজেও। এভাবে অপত্য প্যারামেসিয়াম সৃষ্টি হয়। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় “কনজুগেশন”।

তাই বলে ভেবো না যে অপত্য প্যারামেসিয়াম সৃষ্টির জন্য দুটো প্যারামেসিয়ামের কাছে আসতে হয়। একটা প্যারামেসিয়াম থেকেও নতুন প্যারামেসিয়ামের জন্ম হতে পারে। একে বলে এন্ডোমিক্সিস (Endomixis)। আবার দুটো কোষ মিলেও একটি কোষে পরিণত হতে পারে। একে বলে সিনগ্যামি (Syngamy)। কত খেলা যে আছে!

হারকিউলিসের কথা নিশ্চয়ই জানো! বাবাজী যখনি বিশাল দৈত্যাকার ড্রাগনের মাথা কাটতো, তখনি বেটার নতুন মাথা গজাতো, তাও একটার জায়গায় দুই-তিনটা বা তারও বেশি। রূপকথার ঐ ভয়ঙ্কর ড্রাগনের মতো জীবজগতেও একটি জীব আছে, যারা ঠিক এভাবেই বংশবৃদ্ধি করে। এই প্রাণীটি হলো Hydra। ঐ ড্রাগনের নামও হাইড্রা। যাহোক, কোনো কারণে যদি আমাদের এই হাইড্রার দেহ আড়াআড়ি বা লম্বভাবে দুই বা ততোধিক খন্ডে বিভক্ত হয়, তাহলে প্রত্যেক খন্ড থেকে নতুন হাইড্রা জন্মায়। অনেকটা সেই কৃমির মতো।

হাইড্রার বংশবৃদ্ধির আরেকটি উপায় আছে। এক্ষেত্রে হাইড্রার এপিডার্মিসে ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ বিভাজিত হয়ে একটি স্ফীত অংশ তৈরি করে, যা পরবর্তীতে Bud বা মুকুলে পরিণত হয়। এরপর এখানে এপিডার্মিস, গ্যাস্ট্রোডার্মিস এবং মেসোগ্লিয়া তৈরি হয়ে যায়। মুকুলটি মাতৃ হাইড্রার কাছ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে। এরপর একটা সময়ে গিয়ে এটি পরিপক্কতা লাভ করে। পরবর্তীতে মাতৃ হাইড্রা ও এটির সংযোগস্থলে একটি খাঁজ বা ভাজ সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে অপত্য হাইড্রা মাতৃদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একটি হাইড্রার অনেকগুলো মুকুল তৈরি হতে পারে। আবার একটি মুকুল অন্য একটি মুকুল তৈরি করতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই পুরো পদ্ধতির একটা গালভরা নাম দিয়েছেন, সেটা হলো মুকুলোদাম (Budding)।

এসব ছোটখাটো জীবদের কথা শুনতে শুনতে আপনি হয়ত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন। চলুন, বড় কোনো শিকার ধরা থাক। তবে প্রথম উদাহরণটা হৃদয় বিদারক হলেও হতে পারে। নিশ্চয়ই আপনি প্রেয়িং ম্যান্টিসের নাম শুনেছেন। যখন পুরুষ ম্যান্টিস স্ত্রী ম্যান্টিসের সাথে মিলিত হয়, তখন স্ত্রী ম্যান্টিস এক ধরনের নির্মম আচরণ করে। সে তার সঙ্গীকে খেতে থাকে। এক্ষেত্রে প্রথমে মাথা খাওয়া শুরু করে এবং পরবর্তীতে অন্যান্য অংশ। এভাবে চলতে চলতে যখন পুরুষ ম্যান্টিসের পেটের দিকের অংশগুলো বাকি থাকে, তখন তাদের মিলন শেষ হয়।

এটার পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। পেটের অংশে (Abdominal Segment) এমন কিছু থাকে, যা মিলনে উত্তেজনা প্রদান করে। কিন্তু দেহের স্নায়ুর সাথে কানেক্টেড একটি অংশ এই উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অংশটিকে Dominate করে রাখে। একারণে স্ত্রী ম্যান্টিস পুরুষ ম্যান্টিসের মাথা খেয়ে ফেলে, যাতে মিলন প্রক্রিয়ায় বাধা না আসে। কী সাংঘাতিক!

সী ল্যাম্প্রে, ঈল কিংবা স্যামন মাছের প্রজননের ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটে, যা তাদের জীবনকে বিদায় জানাতে প্রভাবিত করে। যেমনঃ সী ল্যাম্প্রে যখন যৌন-পরিপক্বতা লাভ করে তখন তার পৌষ্টিকতন্ত্র নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর ফলে খাদ্য ও দেহের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। আর এটাই ওদের মৃত্যুর কারণে পরিণত হয়।

ঈলগুলো ডিম দেওয়ার জন্য সাগরে ভ্রমণ করে। আর এই দীর্ঘ যাত্রা শেষে ডিম দিয়েই ঈলগুলো মারা যায়। এসব ঈলদেরও পৌষ্টিকতন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। একই ঘটনা স্যামন মাছদের ক্ষেত্রেও ঘটে। তাদের পুরুষ প্রজাতির চোয়ালগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এই অবস্থা নিয়েই স্যামনগুলো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ডিম পাড়ে। আর এই যাত্রায় তারা বারবার আহত হয়। সব মিলিয়ে তারা প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় ডিম পাড়ে এবং এর পরপরই জীবনাবসান ঘটে।  ল্যাম্প্রে, স্যামন বা ঈলের বাচ্চাগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে বড় হয়। এরপর একটা সময়ে গিয়ে তারাও যৌন-পরিপক্বতা লাভ করে। তারপর তাদের বাবা-মার মতো তারাও দুটো জিনিসকে একসাথে বেছে নেয়। একটি বংশবৃদ্ধি এবং অন্যটি মৃত্যু। দুঃখজনক বটে!

ক্লান্তি আর বিস্ময়ের সাগরে ডুব দেওয়া পাঠকদেরকে আমি আর বিরক্ত করবো না। এখানেই দাঁড়ি দিতে চাচ্ছি। তবে তার আগে কিছু কথা না বললেই নয়। আমাদের এই জীবজগৎ বড়ই বিচিত্রময়। এক প্রজনন ব্যবস্থাই জীবজগতে বাহু ধারা ও ঘটনার অবতারণা করেছে। তাহলে একবার ভেবে দেখুন তো অনাবিষ্কৃত জীবগুলোর বংশবৃদ্ধির পদ্ধতি কতটা বিচিত্র হতে পারে। আর যদি এই পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে সেখানেও কি বৈচিত্র্য থাকতে পারে? সেখানেও কি বংশবৃদ্ধির এরকম তালগোল থাকবে?

তথ্যসূত্রঃ
১. Parthenogenesis | Definition, Types, & Facts – Britannica
২. Types of reproduction
৩. Hydras | Missouri Department of Conservation
৪. Paramecium: conjugation
৫. Sea Lamprey Biology
৬. How Do Eels Reproduce?

লেখাটি 60-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।