গত শতাব্দীর আশির দশকের ঘটনা। ঘটনার প্রধান চরিত্র প্যাট্রিশিয়া স্টলিং নামের একজন নারী। আমেরিকার মিজৌরিতে বাস করতেন তিনি, কাজ করতেন একটা দোকানে। আর দশজনের মতোই একসময় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ডেভিড বলে একজনের সাথে। বিয়ের পরের বছরই প্যাট্রিশিয়ার কোল আলো করে জন্ম নেয় রায়ান। সবকিছুই ভালো চলছিলো, কিন্তু একদিন তিন মাস-বয়সী রায়ান হঠাৎ অস্বাভাবিক বমি করতে শুরু করে। কোনোভাবেই তাকে খাওয়ানো যায় না। শ্বাস নিতে সমস্যা হতে লাগলো। আকস্মিকভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়া শিশুকে নিয়ে ভীত মা হাসপাতালে গেলেন।
হাসপাতাল জানালো রায়ানের দেহে বিষাক্ত ইথিলিন গ্লাইকল পাওয়া গেছে। ইথিলিন গ্লাইকল মোটর ইঞ্জিনে ব্যবহৃত এন্টিফ্রিজের প্রধান উপাদান। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কথা, যে বিপজ্জনক মাত্রায় এটি পাওয়া গেছে, তাতে সন্দেহ হয় তাকে বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ডাক পড়লো পুলিশের।

প্যাট্রিশিয়ার বাসায় এন্টিফ্রিজের গ্যালন পাওয়া গেলে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। ভর্তির দশদিন পর রায়ানকে আপাতত দেওয়া হলো একটি পালক পরিবারের কাছে। প্যাট্রিশিয়া শুধু অল্পসময়ের জন্য তার সাথে দেখা করার সুযোগ পান।
একবার প্যাট্রিশিয়া দেখা করার তিন দিন পরেই, আশ্চর্যজনকভাবে আবার রায়ানের দেহে পূর্বের উপসর্গগুলো দেখা দিতে শুরু করলো। প্যাট্রিশিয়া সেবার তাকে বোতলে দুধ খাইয়েছিলেন। এবার আর শিশুটিকে বাঁচানো গেলো না। পরীক্ষায় দেখা গেলো, যে বোতলে প্যাট্রিশিয়া দুধ খাইয়েছেন, তাতে ইথিলিন গ্লাইকল উপস্থিত। পুলিশ তার মা’কে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করলো।
কারারুদ্ধ অবস্থাতেই বিষণ্ণ প্যাট্রিশিয়া দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিলেনঃ ডেভিড জুনিয়র। জন্মের পরেই তাকে মায়ের থেকে আলাদা করে নিরাপদ পালক পরিবারের কাছে দেওয়া হলো। কিন্তু হায়! এই শিশুটিও তার অগ্রজের মতো উপসর্গ দেখাতে শুরু করলো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জোরদার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বললো, এই শিশু মিথাইলম্যালোনিক এসিডেমিয়া বা এমএমএ (MMA) নামক এক বিরল জেনেটিক রোগে আক্রান্ত।

আমরা যে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেয়ে থাকি, তার মূল একক হলো অ্যামিনো এসিড।
এমএমএতে আক্রান্ত রোগী চারটি বিশেষ অ্যামিনো এসিডের পরিপূর্ণ বিপাক করতে পারে না। জিনগত অস্বাভাবিকতার কারণে তাদের দেহে একটি প্রয়োজনীয় এনজাইমের অভাব থাকে। অসম্পূর্ণ বিপাকের ফলে রক্তে প্রোপিওনিক এসিড এবং মিথাইলম্যালোনিক এসিড নামে দুটি উপজাত পদার্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে, যার ফলে মস্তিষ্ক, যকৃৎ এবং অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতিসাধন হয়। সাথে সাথে প্রকট হয় উদ্দিষ্ট লক্ষণগুলো। পরিসংখ্যান বলে, প্রতি ৪৮,০০০ মানুষের একজনের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে যার হবে,তার জন্য এটা মারাত্মক এবং তার আয়ু ভীষণভাবে কমে যেতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই রোগের উপসর্গগুলো অনেকটাই ইথিলিন গ্লাইকল বিষক্রিয়ার সাথে মিলে যায়!
যাহোক, আগেভাগে রোগ শনাক্ত হওয়ায় খাদ্যাভাস নিয়ন্ত্রণ করে দ্বিতীয় শিশুটিকে বাঁচানো গেলো। এই ঘটনায় প্যাট্রিশিয়ার আইনজীবীরা নড়েচড়ে বসলো। তবে কি রায়ান’ও একই রোগে ভুগেই মারা গেছে? এমন কি হতে পারে হাসপাতালের পরীক্ষায় প্রোপিওনিক এসিডকে ভুল করে ইথিলিন গ্লাইকল বলে শনাক্ত করা হয়েছে?
বৈজ্ঞানিকভাবে দুটিই সম্ভব!
কিন্তু বিধি বাম। আসামীপক্ষের এই আর্জি আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো না। রায়ানের’ও যে একই জন্মগত রোগটা আছে, এটা প্রমাণ করার সুযোগ তাদের হাতে ছিলো না। বিচারে পঁচিশ বছর বয়সী প্যাট্রিশিয়ার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো।
সেসময়ের একটা জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘আনসলভড্ মিস্ট্রি’ প্যাট্রিশিয়ার ঘটনা অবলম্বনে একটা পর্ব করলো; রায়ান বিষক্রিয়ায় নয়, বরং এমএমএ’তে ভুগে মারা যেতে পারে এই সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করে। এই অনুষ্ঠান প্রচারের পর উইলিয়াম স্লাই নামে সেইন্ট লুইজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতনামা প্রাণরসায়নবিদ এই ঘটনা নিয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসেন। একই প্রতিষ্ঠানের আরেক সহকর্মী, জেমস শুমেকারকে নিয়ে আবার রায়ানের নমুনা পরীক্ষা করতে বসেন। ক্রোমাটোগ্রাফি এবং স্পেকট্রোমেট্রির মতো জটিল রাসায়নিক বিশ্লেষণের সাহায্যে নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করে তারা প্রমাণ করেন রায়ানের রক্তে ইথিলিন গ্লাইকল নেই। বিপাক-সংশ্লিষ্ট রোগে বিশেষজ্ঞ তৃতীয় একজন বিজ্ঞানীকে দিয়ে যাবতীয় তথ্যাদি যাচাই করানো হয়। তার নাম পিয়েরো রিনাল্ডো। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে তিনি কাজ শুরু করেন। তিনি দেখেন, রায়ানের নমুনায় উচ্চমাত্রায় মিথাইলম্যালোনিক এসিড উপস্থিত। ইথিলিন গ্লাইকলের অনুপস্থিতির ব্যাপারেও অন্য দুজন বিজ্ঞানীর পক্ষেই সায় দেন।

তাহলে আগের রিপোর্টগুলোর কী হবে?
রিনাল্ডো দুটি রিপোর্ট হাতে পান। দুঃখজনকভাবে দুটি রিপোর্টই মারাত্মক ভুল করেছিলো। একটি রিপোর্টে ইথিলিন গ্লাইকল মিশ্রিত আদর্শ নমুনার সাথে না মেলা সত্ত্বেও লেখা হয়েছে রায়ানের রক্তে ইথিলিন গ্লাইকল উপস্থিত। দ্বিতীয় রিপোর্টে এক ‘অস্বাভাবিক’ পদার্থের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু অধিকতর অনুসন্ধানের সুপারিশ ছাড়াই চালিয়ে দেওয়া হয়েছে ইথিলিন গ্লাইকল বলে। দেখা যায়, দুধের বোতলের রিপোর্টেও নিশ্চিতভাবে কিছু পাওয়া যায় নি।
সকল বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত আদালতে হাজির করা হলো। প্রমাণিত হলো সে’ও তার ভাইয়ের মতোই এমএমএ’তে আক্রান্ত হয়েই মারা গেছে। তাঁর মা সম্পূর্ণ নির্দোষ!
দুই বছর কারাবাসের পর প্যাট্রিশিয়া সকল দোষমুক্ত হয়ে জেল থেকে ছাড়া পান। কনিষ্ঠ সন্তান ডেভিডকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যে হাসপাতাল এবং ল্যাবরেটরি প্রথমে রায়ানের রক্ত পরীক্ষা করেছিলো, প্যাট্রিশিয়া তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেন। কয়েক মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে মামলার নিষ্পত্তি হয়।
জিনতত্ত্বের পরিসংখ্যান বলে পরপর দুই সন্তানের এই ধরনের একই জেনেটিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ষোলো ভাগের এক ভাগ। তার মানে, রোগাক্রান্ত রায়ানের পর ডেভিড জুনিয়রের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিলো। যদি তাই হতো, তাহলে কি ডাক্তাররা কখনোই এই অসুখটা ধরতে পারতেন? প্যাট্রিশিয়া কি তখন সুবিচার পেতেন?
এ যাত্রায় তো তাকে বাঁচিয়ে দিলেন তিন জীববিজ্ঞানী!
তথ্যসূত্র-
- Scientific studies solve a murder mystery, Nelson and Cox, Lehninger Principles of Biochemistry
- Proteins Are the Workhorses of the Cell: Misdiagnosis of a Metabolic Malady – Genetic Twists of Fate – NCBI Bookshelf
- How Patricia Stallings Was Wrongfully Convicted Of Murdering Her Own Baby
- Patty Stallings – Unsolved Mysteries
Leave a Reply