সামুদ্রিক অক্টোপাসের সাথে খেলা অ্যাকোয়ারিস্ট স্টেসি টনকিনের কাজের অংশ। ডেভি জোনস নামের একটি অক্টোপাসের সাথে তার ভালোই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সে যখন খাবার দেয়, তখন অক্টোপাসটি স্বতস্ফূর্তভাবে তার গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। সাধারণত অক্টোপাস প্রায় চার বছর বেঁচে থাকে, তাই এই এক বছর বয়সী অক্টোপাসটি স্টেসির কাছে অনেকটা কিশোরের মতোই।
স্টেসি ব্রিস্টল অ্যাকোয়ারিয়ামের পাঁচজন অ্যাকোয়ারিস্টের একটি দলের একজন সদস্য। তিনি অনেকদিন ধরেই অক্টোপাসটিকে পর্যবেক্ষণ ও যত্ন করছেন। তার মতে, অক্টোপাসের নির্দিষ্ট ও সুসংজ্ঞায়িত অনুভূতি রয়েছে। ডেভি জোনস (সংক্ষেপে ডিজে) তার মেজাজের সাথে সাথে নিজের রংও বদলায়। স্টেসি বলেন, “অক্টোপাস তার চোখের মাধ্যমে তার বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ করে।“ এই অক্টোপাসটি কোনো কোনো দিন শুধু ঘুমায় আবার কোনোদিন খেলা আর ঘুরে বেড়ানোতে মেতে ওঠে।
যাহোক, স্টেসি অক্টোপাসের সংবেদনশীলতা নিজে বুঝেছেন এবং অন্যদেরকেও বোঝাতে চেয়েছেন, যেটা অনেকটা যুক্তরাজ্যের Animal Welfare (Sentience) Bill এর মূল ব্যাপারের সাথে জড়িত। বিশেষজ্ঞদের একটি দল ৩০০ টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষা করার পরে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে অক্টোপাসগুলি “সংবেদনশীল প্রাণী”। এর স্বপক্ষে “শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক প্রমাণ” ছিল যে তারা আনন্দ, উত্তেজনা এবং দুঃখ অনুভব করতে পারে ।
অক্টোপাসের একটি বড় এবং জটিল মস্তিষ্ক আছে। তাদের বুদ্ধিমত্তা অসংখ্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। পরীক্ষণ থেকে দেখা গেছে যে তারা নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখতে এবং রক্ষা করার জন্য নারিকেল এবং ঝিনুক ব্যবহার করেছে। এমন অনেক নজির আছে, যেখানে তারা অ্যাকোয়ারিয়াম এবং মাছ ধরার জন্য তৈরি করা ফাঁদ থেকেও বুদ্ধিমত্ত্বার সাথে পালাতে পেরেছে।
মজার ব্যাপার হলো, ৫৬০ মিলিয়ন বছর আগে মানুষ এবং অক্টোপাসের একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল, যে ব্যাপারে ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী ডক্টর জ্যাকব ভিনথারও একই কথা বলেছেন। তাঁর মতে, যদিও অক্টোপাসেরা মানুষের থেকে গঠনে ও চলনে অনেকাংশেই ভিন্ন, তবে তাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং কৌতূহল মানুষেরই মতো। তাই এটিকে মানুষের সাথে তুলনা করাই যায়। সুতরাং, অক্টোপাস চাষকে যেন-তেন মনে করাটা ঠিক হবে না।
গবেষক এবং লেখকেরা বলছেন যে এ ধরণের ভদ্র ও সংবেদনশীল অক্টোপাস চাষ করাটা ঠিক হবে না এবং সরকারের উচিৎ অক্টোপাস চাষের উপর নিষেধাজ্ঞারোপ করা। কিন্তু অক্টোপাসের কর্ষিকা (tentacle) প্যানে এবং প্লেটে সিদ্ধ করে অনেক জায়গায় স্যুপ হিসেবে খাওয়া হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায়, মাঝে মাঝে প্রাণীদেরকে জীবন্ত খাওয়া হয়। বন্য অক্টোপাসের সংখ্যা কমছে এবং দাম বাড়ছে। প্রতি বছর আনুমানিক ৩,৫০,০০ টন অক্টোপাস ধরা হয়, যা ১৯৫০ সালে ধরা পড়া অক্টোপাসের সংখ্যার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। এভাবে অক্টোপাস ভক্ষণের কারণে প্রতিবছর এই জীবদের সংখ্যা পরিবেশ থেকে কমে যাচ্ছে।
কিন্তু, এই ক্ষতির দিকে নজর না দিয়ে বেশ কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা ভোক্তাদের চাহিদা নিয়ে ভাবছে। স্প্যানিজ বহুজাতিক কোম্পানি নুয়েভা পেসকানোভা ঘোষণা করেছে যে তারা ২০২৩ সালে বিক্রি করার জন্য আগামী গ্রীষ্মকালীন সময়ে চাষ করা অক্টোপাসের বাজারজাতকরণ শুরু করবে। জানা গেছে, এই কোম্পানির খামারটি বছরে ৩,০০০ টন অক্টোপাস চাষ করবে, যেটা সংখ্যায় কিন্তু কম নয়। অক্টোপাসগুলোকে কী অবস্থায় রাখা হবে সে সম্পর্কে কোনো বিবরণ প্রকাশ করতে কোম্পানিটি অস্বীকার করেছে। ট্যাঙ্কের আকার, অক্টোপাসের খাবার এবং কীভাবে পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হবে সবই গোপন রাখা হয়েছে।
গবেষকদের একটি দল এই পরিকল্পনাগুলোকে নৈতিক এবং পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে অযৌক্তিক বলেছেন। এটিকে নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে কম্প্যাশন ইন ওয়ার্ল্ড ফার্মিং (সিআইডব্লিউএফ) স্পেন সহ বেশ কয়েকটি দেশের সরকারকে চিঠি দিয়েছে। সিআইডব্লিউএফ এর গবেষণা ব্যবস্থাপক ড. এলেনা লারা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, “এই প্রাণীগুলি চমৎকার। যদিও তারা একাকী থাকে, তবে তারা খুব বুদ্ধিমান। তাই তাদেরকে এ ধরণের অনুর্বর ট্যাঙ্কে রাখাটা অনুচিৎ।“ যদি অক্টোপাসগুলোকে বদ্ধ ট্যাঙ্কে রাখা হয়, তবে অল্পতেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে একটি ট্যাঙ্কে একাধিক অক্টোপাস থাকলে তারা একে অপরকে খেতে শুরু করতে পারে।
অক্টোপাস এবং অন্যান্য অমেরুদণ্ডী সেফালোপডগুলিকে সংবেদনশীল প্রাণী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন বলছে যে খামারে চাষের জন্য শুধুমাত্র মেরুদন্ডী প্রাণীদেরকে নির্বাচন করা যাবে। একারণে সিআইডব্লিউএফ অক্টোপাসের এধরণের চাষকে জোর গলায় “নির্বিচারে হত্যা” বলছে। এটি মোটেও নৈতিক নয়। কারণ, প্রাণীগুলো ট্যাঙ্কে থাকাকালীন সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে কষ্ট পাবে।
তবে, নুয়েভা পেসকানোভা তাদের ওয়েবসাইট থেকে বলেছে যে অক্টোপাস চাষের সিদ্ধান্তটি মাছ চাষের মতোই। এটি পরিপূরক হিসেবে টেকসই, নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর হবে। তারা জানিয়েছে যে এর ফলে মৎস্য শিকারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চাপ কমবে। কিন্তু, ড.লারা এই কথাগুলোর বিরোধিতা করে বলেছেন, “NP এর কাজগুলো সম্পূর্ণরূপে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা এবং কোম্পানির পরিবেশগত যুক্তি অযৌক্তিক।“ তিনি বলেছেন যে অক্টোপাস চাষের ফলে মাছের উপরে চাপ বাড়বে। কারণ, অক্টোপাসের খাদ্য হিসেবে ট্যাঙ্কের মধ্যে প্রচুর মাছ সরবরাহ করতে হবে।
ড.লারা ভোক্তাদের ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন। তাঁর মতে, চাষ করা অক্টোপাসের চেয়ে ধরা পড়া অক্টোপাস খাওয়াটা বেশি ভালো। চাষ করা অক্টোপাসের অনিয়মিত খাদ্যগ্রহণের উপর ভিত্তি করে প্রাণীগুলো অপুষ্টও হতে পারে। কারণ, কৃ্ত্তিম উপায়ে ট্যাঙ্কে খাদ্য প্রদান করলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা সম্ভবপর নাও হতে পারে। জেনিফার জ্যাকুয়েটের নেতৃ্ত্বে হওয়া ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় বলা হয় যে অক্টোপাস চাষ নিষিদ্ধ করলে মানুষ তো আর না খেয়ে থাকবে না।
এভাবেই বিতর্ক-বিরোধিতা চলছে, যা সম্পূর্নরূপে জটিল একটা অবস্থান সৃষ্টি করেছে। ড.লারা এবং ড.ভিনথারের মতো বিশেষজ্ঞরা অক্টোপাসের ঘোর বিরোধী হলেও নুয়েভা পেসকানোভার মতোই বেশ কিছু কোম্পানি এবং মানুষেরা এই ব্যাপারটাকে সাধারণ চোখেই দেখছে। তাই এর শেষ পরিণতির ব্যাপারে এখনি কিছু বলা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
Leave a Reply