বোধ হওয়ার পর থেকে মুখস্ত করে এসেছি, “পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। পৃথিবীর তি…”।
তবে সময় গড়ানোর সাথে সাথে, আমার বোধ তার নিজের সীমা পরিসীমা ছাপিয়ে কৌতুহলে রুপ নিতে থাকে। ভাবতে থাকি, পৃথিবীর তিন ভাগ কি কেবলই জল? পরক্ষণেই মনে হয়- না একেবারেই না! এই “সাধারণ” জলের গর্ভে যেই তরল মহাবিশ্ব লুকায়িত, তা উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয়নি আমার। কেননা রুপকথার জলপরীদের জীবন নিয়ে শৈশবে আকাশ কুসুম কল্পনা করতাম। তাই নিজেরও জলপরী হওয়ার বাসনা ছিল প্রকট! যে জল ভালোবেসে জলপরী হওয়ার স্বপ্ন দেখে, আমার মতে সে পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশকেই ভালোবাসে। আর এই ভালোবাসা থেকেই ত্রিভুবনের যত নীল দরিয়া বিদ্যমান, তাদের সাথে আমার গড়ে ওঠে অকৃত্রিম সখ্যতা কিংবা আত্মার বন্ধন। বাবার সাথে শৈশবে “ফাইন্ডিং নিমো” মুভিটি দেখাকালীন নাম না জানা অনেক সামুদ্রিক জীবের প্রাণবন্ত আকার দেখেছিলাম।
বড়ো হওয়ার পর প্রশ্ন জাগে, “গভীর সমুদ্রের মাছ এবং আমার প্রতিনিয়ত ভোজন যোগ্য মাছে এত তফাত কেন? কেন সামুদ্রিক অধিবাসীরা দেখতে এতটাই ভয়ংকর যে দেখামাত্রই গা শিরশির করে ওঠে? কেন কিছু মাছের ধারালো “দাঁত” থাকে? কেন কিছু মাছের দুটো চোখ মানুষের চোখের মতো একই সমতলে পাশাপাশি অবস্থান করে? কেন-ই বা কেউ কেউ নিজেদের কপালে ভাগ্যের জায়গায় লণ্ঠন (আলো) নিয়ে ঘুরে? অনিয়ন্ত্রিত কৌতুহলের পাল্লায় পড়ে বাধ্য হই জ্ঞান দুয়ারের শরণাপন্ন হতে। ফলস্বরূপ সামুদ্রিক প্রানীর ভুতুড়ে আকৃতি ও অদ্ভুত যত ক্ষমতার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হই ও পরিশেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। জ্ঞান অর্জনের পর খানিক দুঃখও হয় বটে। আজকের প্রবন্ধে সেই সকল ক্ষুদ্র জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে যাচ্ছি যে প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর অন্তত আমার শিশুকালে কেউ দেয়নি।
“গভীর সাগরের মাছের গড়ন অদ্ভুত কেন?”- এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জেনে আসি সাগরের তলের দেশটা প্রকৃতপক্ষে কেমন। ওয়াল্ট ডিজনির চিরসবুজ “দি মারমিড এবং ফাইন্ডিং নিমো” এর মতো রঙচঙা? না-কি রাত্রিকালে ল্যাম্পপোস্টের বাতি নেভানো কোনো রাস্তার গলির মতোই অন্ধকার?
সাধারণ জ্ঞান অনুযায়ী, সমুদ্রের তলদেশের অবস্থা অন্ধকারই বটে। সূর্যের আলো সমুদ্রের গভীরে একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পৌঁছে থাকে। তাই একেবারে সমুদ্রের তলদেশের অধিবাসীরা, জীব বৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র ইত্যাদি সূর্যের আলো, তাপ ও শক্তি থেকে সম্পূর্ন ভাবে বঞ্চিত। বিশাল একটা গোষ্ঠী সূর্যের আলো, তাপ ও শক্তি না পাওয়া অঞ্চলে বসবাস করে বিধায় বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের শরীরে আসে পরিবর্তন। এরই ফলস্বরুপ আমাদের ভোজন যোগ্য মাছ এবং অতল সমুদ্র দেশের মাছেরা একে অপরের থেকে এত বেশি ভিন্ন হয়। তারা ভয়াবহ পরিবেশে বেঁচে থাকাটাকে তথাকথিত সুশ্রী হওয়ার উপরে বেছে নিয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত নিম্নতাপ, অতিরিক্ত জলের চাপ, আলোর অনুপস্থিতি এবং এরকম অঞ্চলে শিকার করার অভিনব কৌশল আয়ত্ত করা- গভীর সামুদ্রিক জীবদের করে তোলেছে মানবকুলের কাছে “ভয়ানক বা কুৎসিত”।
গভীর সাগরের তলদেশ বলতে কী বোঝায়?
এই যে এতক্ষণ ধরে গভীর সাগরের তলদেশের কথা বলছি, সেই গভীর সাগর প্রকৃতপক্ষে কাকে বলা হয়? বিভিন্ন মতে সাগরের ৬০০০ মিটার অথবা এরও বেশি বা ৩২৮০-১৯৬২৫ ফিট বা এরও বেশি থেকে “গভীর সাগর”-এর স্তর শুরু হয়।
এই অঞ্চলে সূর্যের আলো বলতে গেলে পৌছায়ই না। অন্ধকারে পরিপূর্ণ এই স্তরটিতে যেসকল প্রানীকুল থাকবে তা স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত পানির চাপে থাকবে। সুতরাং এদের দৈহিক গড়নও হয়ে ওঠে চাপ সহনীয় যা মানবচক্ষুর নিকট কুৎসিত। আরও কথা আছে, সাগরের এই স্তরে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ এত কম যা থাকা না থাকা সমান। জীবিত প্রানী কীভাবেই বা এত অল্প অক্সিজেনে বেঁচে থাকে তা অবশ্যই ভাববার বিষয় ৷ সুতরাং যারা এরকম বিরল পরিস্থিতিতে শ্বাস নিতে সক্ষম তারা কেমন দেখতে হতে পারে তা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে। তাপমাত্রাও হয়ে থাকে -১ থেকে -৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝে যা জীবনের জন্য মহা প্রতিকূল। আমরা একে একে বিস্তারিত জেনে নিই কোন কোন বিষয়াদির কারণে সামুদ্রিক মাছেরা দেখতে এমন বিভৎস হয়।
আলোহীন কিংবা অদৃশ্যলোক
ওই যে বলে না, আরেকজনের জুতোয় না থাকলে বোঝা যায় না সে কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে- ব্যাপারটা ঠিক তেমন। আপনি ভয়ংকর প্রানীদের জায়গায় একবার নিজেকে রাখুন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হলো বেঁচে থাকার তাগিদে। আপনি আশেপাশে কোনো কিছুই দেখছেন না। কিন্তু খাবার আপনাকে খুঁজতেই হবে। তাহলে এখন কী করবেন?
খাদ্য খাওয়ার পূর্বে প্রথমে আপনাকে খাবার তো খুঁজতে হবে। কিন্তু কবরের মতো অন্ধকারে আপনি হাতড়ে পাতড়ে আর কতোটুকুই বা খাবার খুঁজতে পারবেন?
এত জটিল করে ভাবার কিছু নেই। কেননা পৃথিবীর নিয়ম অনুযায়ী, বেঁচে থাকার জন্য বিবর্তনের মাধ্যমে আপনার অথবা আপনার পরবর্তী প্রজন্ম এমন চোখ নিয়ে জন্মাবে যেটা এত পঁচা অন্ধকারেও দেখতে সক্ষম। তবে সেই চক্ষু যুগল আর আমার আপনার মতো স্বাভাবিক হবে না। এমন হবে যা দেখে ভয় পেতে সক্ষম স্বয়ং চক্ষুর মালিকও! তো সমুদ্রের তলদেশের এসকল প্রানীরা সাগরের যে স্থানে বাস করে সেখানে “সকল শক্তির উৎস” আলো দিতে একেবারেই অক্ষম। ফলে জায়গাটি থাকে হরহামেশা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিন রাতের তফাৎ আলাদা করে বোঝা যায় না। আর আলো না থাকলে প্রানীরা কী করে দেখে? প্রকৃতপক্ষে এরকম অন্ধকার পরিবেশে “দেখতে” পাওয়ার অবিরাম চেষ্টায় কালের বিবর্তনে তাদের চোখে জায়গা নিয়েছে বিশালাকার বিভৎস লেন্স। এই বিভৎস লেন্স দিয়ে তারা দেখতে সক্ষম হয় ছোটো থেকে ছোটো প্রানীর চলাচল। কেউ কেউ দেখার প্রয়োজনে ব্যবহার করে বায়োলুমিনেন্স যা প্রকৃতপক্ষে অনুজীব হতে তৈরি প্রাকৃতিক আলো এবং তা তাদের শরীরেই তৈরি হয়। শিকার খোঁজার জন্য বিভৎস লেন্সকে ঠাই দিতে তাদের চোখের আকার হয়ে যাবে বিশাল বড়ো। ভয়ংকর চেহারার হাতেখড়িটা তাই তাদের চোখ থেকেই শুরু হয়।
খাদ্য সংকট বা দূর্লভ শিকার
সাগরের তলদেশে নেই আলোর উৎস। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের খাবার খুঁজতে সম্মুখীন হতে হয় অপ্রতিকূলতার। শিকার তেমন একটা নেই বললেই চলে। কিন্তু যদি থেকেও থাকে তবে অন্ধকারের পাল্লায় পড়ে সেই শিকার আর নিজ থেকে ধরা দেয় না, লুকিয়ে পড়ে দ্রুত। তাহলে উপায় কী? সাগর তলদেশের প্রানীরা কী খেয়ে বাঁচবে?
প্রথমতো, পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে তারা দূর্লভ খাদ্যেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। খাবার আসলে খেলাম না আসলে খেলাম না ব্যাপারটা তারা মেনেই নেয়৷ তবে যেহেতু বিবর্তনের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি-ই পেয়েছে, তাই তারা এই শক্তির চর্চা করতে পিছপা হয় না। অল্প পরিমান খাবারের নড়াচড়া দেখলেও তা তাদের চক্ষুজোড়ায় নাড়া দেয়। আর সাথে সাথে সেই খাবার মুখে পুড়তে পারে। আরো একখানা ব্যাপার তাদের ভেতর কাজ করে সেটা হল- প্রায়শই, শিকারের জন্য ওঁত পেতে থাকে সাগরের কিছু প্রাণী। তো যারা ওঁত পেতে শিকার ধরে তাদের মুখ দীর্ঘ, ধারালো দাঁত দিয়ে পূর্ণ থাকে। আর এই দাঁতগুলোই তারা শিকার ধরতে ব্যবহার করে এবং যে কোন ভোজ্য বস্তু ধরতে প্রস্তুত থাকে। দাঁত ওয়ালা মুখগুলো অস্বাভাবিক বড় আকারের হয় এবং তাদের চোয়ালগুলো কবজা যুক্ত থাকে। একই সাথে বিশালাকার পেট এবং সম্প্রসারণশীল দেহ সঙ্গ দিয়ে এই প্রানীগুলোকে যেকোনো খাবারের সুযোগ নেওয়ার জন্য তাদের সক্ষম করে তোলে। এমনকি সেই খাবারটি তাদের চেয়ে আকারে ওজনে বড় হলেও কিছু আসে যায় না। গভীর সমুদ্রের অ্যাংলার ফিসের কথা এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। তাদের মুখের দিকে শিকার টানার জন্য ভয়ংকর দেখতে জলজলে লাঠির মতো একটা বস্তু থাকে যা তাদের ব্যাক্তিগত ফিশিং রড হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্যাপারটা চমৎকার না?
জলের অতিরিক্ত চাপ
অনেক প্রশিক্ষণের পর একজন মানুষ ডুবুরির মতো দেবদূত হয়ে উঠতে পারেন৷ কিন্তু ডুবুরী হতে অনেক প্রশিক্ষণের কেন প্রয়োজন? কারণ, পরিমিত প্রশিক্ষণ ছাড়া জলের তলদেশে অভিযান চালাতে গেলে মুখোমুখি হতে হয় ভয়াবহ চাপের। এই জলের চাপে মানুষ বা যেকোনো স্থলের প্রানীর ধমনী শিরা ফেটে ভেতরেই রক্তক্ষরণ হতে পারে। ঠাস ঠাস করে ফেটে যেতে পারে শরীরের নরম অন্ত্রতন্ত্র গুলোও। শরীরকে চাপ সহনীয় না করে কারও পক্ষেই গভীর সমুদ্রে অভিযান করতে যাওয়া সম্ভব না। তাহলে বুঝুন, যারা ওখানে বাস করে তাদের শরীর চাপ সহনীয় হওয়ার জন্য ঠিক কতোটা অদ্ভুত হতে পারে? বেঁচে থাকার তাগিদে তারা যতটুকু শক্তি ব্যবহার না করলেই নয়, ঠিক ততোটুকুই শক্তি ব্যবহার করে। ফলে অন্যান্য মাছের মতো তাদের সাতারের জন্য তাদের পাখনা না থেকে শরীরটাই লম্বায় বড়ো হয়ে যায়। জলের অতিরিক্ত চাপ সহ্য করার জন্য তাদের সমস্ত কোষ এবং বাহ্যিক আকার অভিযোজিত হয়ে গঠন করে এক ভিন্ন আকৃতির, যা মানবকুলের কাছে সোজা বাংলায় “বিশ্রী”। অন্যদিকে, কিছু প্রানীর সাতার কাঁটার যেমন ক্ষমতা নেই তেমনি কিছু প্রানীর রয়েছে আঁশহীন লিকলিকে শরীর। যা কি-না তাদের বিশ্রী প্রো-ম্যাক্স বানাতে নিঃস্বার্থভাবে ভূমিকা রেখেছে।
নিম্ন তাপমাত্রা
আগেই যেহেতু বলেছি সূর্যের আলো সাগরের তলদেশে স্পর্শ করে না, তাই তাপ পৌছানোর চিন্তা করাটাও বিলাসিতা। পৃথিবীর অন্যতম বরফের দেশ অ্যান্টারটিকায় আমরা পেঙ্গুইন থেকে শুরু করে, পোলার বিয়ার, সীল ইত্যাদি দের দেখতে পারি। তাদের আবার অন্য কোথাও প্রাকৃতিক ভাবে দেখা মেলে না। এদের শরীরের গড়ন এমন যে তারা ঠান্ডা সহ্য করার সীমার ভেতর থাকতে পারে। তাদের চামড়ার স্তর, চর্বির পরিমাণ ইত্যাদি তাদেরকে নিম্নতাপ সহনীয় করতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে৷ একই ভাবে সমুদ্র তলদেশে অবস্থানরত প্রানীকূলের দেহাবরণও মিঠা পানির মাছ কিংবা উপরী সাগরের মাছের শরীরের থেকে ভিন্ন৷ বিনা তাপে বেঁচে থাকাই যার মূল উদ্দেশ্য।
অক্সিজেনের অনুপস্থিতি
পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান গভীর সাগরের তলদেশে নেই বললেও ভুল হবে না। তবে বেঁচে থাকার জন্য তাদের আবার অক্সিজেনের প্রয়োজন আছে ঠিকই। ওইটুকু অক্সিজেনে শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রকৃতির সহায়তায় নিজেদের দেহাকৃতি গড়ে নিয়েছে তারা। কারণ ওই একটা-ই। বাঁচতে হবে।
যা না বললেই নয়-
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে রাখা দরকার মনে করছি। যাদের নিয়ে এতক্ষণ কথা হলো প্রত্যেকেই হয়তো কোনো না কোনোভাবে জল থেকে স্থলে উঠে এসেছে এবং তারপর মানুষের পক্ষে তাদের গড়ন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয়েছে। (বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তলদেশে ক্যামেরা পৌঁছিয়ে জীবগুলোকে দেখতে পাওয়ার আলোচনা আপাতত এক পাশে রাখি।) তো, সেই অতল সাগর দেশের জীবগুলো যখন মুক্ত বায়ুর সংস্পর্শে আসে তখন তাদের ভেতরকার গ্যাসীয় চাপ বেড়ে যায়। এতে করে বেলুনের মতো ফুলে যায় তারা। ফলস্বরুপ তাদের আসল আকৃতি দেখা থেকে বঞ্চিত হয় ভূমিবাসী তথা আমি, আপনি, আমরা। হতেই পারে তারা আসলে এতটা কুৎসিত নয়। কিংবা এতোই বিভৎস যা প্রকাশ করতে গেলে এই লেখা আর শেষ হবে না।
আজ তাই এখানেই বিদায় নিচ্ছি। সম্পূর্ণ পড়ার জন্য প্রিয় পাঠককে অনেক ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply